বছর বারো আগের কথা; স্কুলে পড়ি, ক্লাশ এইটে।। নতুন বই হাতে পেয়ে কবিতা পড়া শুরু করেছি, একটা কবিতায় এসে আটকে গেলাম, চৌদ্দ লাইনের কবিতা; কবিতার নামটা অদ্ভুত, কবির নামও শুনিনি আগে কখনো।
পুরো কবিতা জুড়ে অসংখ্য নদী,পাখি,গাছ,ফুল আর ফলের নাম; পড়ে মনে হল এ কবি আমাদের গ্রাম ঘুরে ঘুরে কোথায় কী হচ্ছে দেখে দেখে কবিতাটি লিখেছেন। ছোটবেলা থেকে পড়ে আসা কবিতা বা ছড়ার সাথে কোন মিলই নেই। ভাল লাগল না, খারাপও না।শুধু কিছুক্ষণের জন্য একটা ঘোর গ্রাস করেছিলো। সেদিন সেই বালককে কেউ বলে দেয়নি যার একেকটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে পুরো জীবন কাটিয়ে দেয়া যায় আমি সেই কবির কবিতা পড়ছি, পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও যার কবিতার উপাদান দিয়ে এই বাংলাকে পুনর্বার নির্মাণ করা যাবে আমি সেই কবির কবিতা পড়ছি; “রূপসী বাংলা”র ৬১টি হীরার একটিকে চোখের সামনে নিয়ে বসে আছি। কবিতাটির নাম ছিল “আবার আসিব ফিরে”।কবির নাম জীবনানন্দ দাশ।
‘রূপসী বাংলা’র কবিতাগুলো প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে; কবির মৃত্যুর তিন বছর পর।। কবির অনুজ অশোকানন্দ দাশের তত্ত্বাবধানে প্রথম প্রকাশিত সে সংস্করণে কবিতার রচনাকাল হিসেবে লেখা ছিল ১৯৩২ সাল। পরবর্তীতে দেবেশ রায়ের সম্পাদনায় ১৯৮৪ সালে কবিতাগুলো আবার এক মলাটে প্রকাশিত হয়; তখন জানা যায় শিরোনামহীন এই ৭৩ টি কবিতা লেখা ৭৬ পৃষ্ঠার রুলটানা খাতায় কবিতাগুলোর রচনাকাল হিসেবে জীবনানন্দ লিখে রেখেছিলেন মার্চ, ১৯৩৪। সেই ৭৩টি কবিতা থেকে ৬১ টি কবিতা বাছাই করে প্রকাশ করা হয়। কাব্যগ্রন্থের নাম ও কবিতার শিরোনাম অশোকানন্দ দাশের দেয়া; প্রতি কবিতার প্রথম পংক্তির প্রথমাংশ’কে কবিতার শিরোনাম হিসেবে বাছাই করা হয়েছিল।
কিছু কিছু কবিতা, কোন কোন কাব্যগ্রন্থ কবিকে অমরতা দেয়; তাঁর জাত চিনিয়ে দেয়। নজরুলের যেমন ‘বিদ্রোহী’, সুকান্তের যেমন ‘ছাড়পত্র’, সুধীনের যেমন ‘শাশ্বতী’, জীবনানন্দের তেমন ‘রূপসী বাংলা’।। কারণ রূপসী বাংলা আসলে কোন কাব্যগ্রন্থ নয়; সব মিলিয়ে একটি সম্পূর্ণ কবিতা, একটি চিত্রকল্প। এ কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র বাংলার প্রকৃতি; জীবনানন্দের অপূর্ব শব্দচয়নে যা হয়ে উঠেছে ‘গভীর গভীরতর অসুখ’ আক্রান্ত পৃথিবীর শুশ্রুষার মতো। মৃত্যু কল্পনার ‘অসম্ভব বেদনার’ সাথে ‘অমোঘ আমোদ’ নিয়ে এ ই-বুকটি অন্তর্জালের অসংখ্য জীবনানন্দ ভক্তকে উৎসর্গ করা হলো।
জীবনানন্দ দাশ
জন্ম : বরিশাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯। আদি নিবাস গাওপাড়া, গ্রাম- বিক্রমপুর। পিতা বরিশাল ব্রজমােহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক সত্যানন্দ দাশ। বরিশাল ব্রজমােহন স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক (১৯১৫), বরিশাল ব্রজমােহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ (১৯১৭) সালে । কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ (১৯২১) ডিগ্রী লাভ। ১৯২২-১৯২৮-এর কলকাতা সিটি কলেজে, ১৯২৯-এ বাগেরহাট কলেজে ও ১৯২৯-১৯৩০-এ দিল্লীর রামযশ কলেজে অধ্যাপনা। ১৯৩০-এ ঢাকার লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। কিছুকাল বেকার জীবন যাপন ইনসিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কিছুদিন কর্ম সম্পাদন। কিছুকাল ব্যবসা করার পর ১৯৩৫-এ বরিশাল ব্রজমােহন কলেজে অধ্যাপনার চাকরি লাভ। ১৯৪৬ পর্যন্ত এ কলেজে অধ্যাপনা। অতঃপর কলকাতা গমন। ১৯৪৭-এ ‘দৈনিক স্বরাজ’-এর সাহিত্য বিভাগ সম্পাদনা। ১৯৫১-১৯৫২- তে খড়গপুর কলেজে, ১৯৫২ তে বড়িষা কলেজে ও ১৯৫৩ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হাওড়া গার্লস কলেজে অধ্যাপনা।
প্রকাশিত উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থ : 'ঝরা পালক' (১৯২৮), ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন' (১৯৪২), সাতটি তারার তিমির' (১৯৪৮), রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭) তিনি একজন কথাসাহিত্যিকও। মৃত্যুর পর প্রকাশিত উপন্যাস : মাল্যবান (১৯৭৩), সতীর্থ (১৯৭৪)। গল্প সংকলন : ‘জীবনানন্দ দাশের গল্প’ (১৯৭৯)। জীবনানন্দ দাশের অপ্রকাশিত রচনাবলী খণ্ডে-খণ্ডে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। মৃত্যু : কলকাতা, ট্রাম দুর্ঘটনা, ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪।