ফ্ল্যাপের কিছু কথাঃ এ যুগের অন্যতম জনপ্রিয় কথাকার সমরেশ মজমদারের কুশলী কলমে কাহিনী বর্ণনার আকর্ষনের জন্যে নয়, স্বাধীনতার উত্তর বাঙালী জীবনের স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রয়াসে মেয়েদের সাধ, সংকল্প ও সংগ্রামের এক জীবন্ত , ধারাবাহিক ছবি ফুটিয়ে তোলার জন্যে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে সুদীর্ঘ, সুকল্পিত, সুবিন্যাস্ত এই দুই পর্বের উপন্যাস ‘সাতকাহন’। দু’-পর্বের এ উপন্যাসের কেন্দ্র চরিত্র সাহসী, স্বাতন্ত্র্যচিহিৃত এক মেয়ে দীপা। দীপাবলী ভাগ্যের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করতে করতে বহু বাধা, বিপর্যয় পার হয়ে সন্ধান পেল অমল এক তীরের । এ সব নিয়েই রচিত হয়েছে প্রথম খণ্ডের কাহিনী।
উত্তর বাংলার চা বাগান, আঙরাভাষা নদী দিয়ে এ উপন্যাসের সূচনা, কাহিনী বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তৃত হয়েছে এর পটভূমি। এখানে স্থান পেয়েছে পঞ্চাশ দশকের কোলকাতার রাজনৈতিক আন্দোলনের ছবি। উত্তর বঙ্গের এক মেয়ে -ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে বড় হয়ে ওঠেছ মাসি আর মেসোমশায়কে মা-বাবা যেনে। অল্প বয়সে মাত্র তিন দিনের জন্য পরেছিল সিঁদুর-শাখা। তা মুছে ফেলে শুরু করতে চায় এক নতুন জীবন। জয় করতে চায় নিজের ভাগ্যকে। সেই মেয়ে-লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তি দান করে যে কপর্দকশূন্য, কাজের মানুষের ভেতরের কুৎসিৎ লোভী চেহারা থেকে যাকে বারবার আঘাত করে , তবু তাকে পারে না পর্যুদস্ত করতে। যার জীবনে এসে মিশে নাটক।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সাহসী মেয়ে-দীপাবলীর নামের মধ্যে নিহিত অন্ধকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আভাস।
দীপার অন্যান্য চরিত্রচিত্রণে, বহুবিচিত্র ঘটনার প্রবল ঘাতপ্রতিঘাতে, চারপাশের নানান চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে সূক্ষ্ণ টানাপোড়েন মানুষী হৃদয়ের বহু অচেনা দিকের নিপুণ উদ্ঘাটনে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের বিরল বিশিষ্ট, বলিষ্ট উপন্যাস, ‘সাত কাহন’।
শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডে সংযোজিত হয়েছে লেখকের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ যা ১৯৭৫ এ দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর থেকে তাঁর উপন্যাসের বিষয় ভিন্ন, গল্প বলার ভঙ্গী পাঠকদের মনে আন্দোলিত করে তোলে। ঘোড়ার রেসকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করেছেন এক চমৎকার কাহিনী। এছাড়াও চলচ্চিত্রের কাহিনীকার হিসেবে বি এফ জে এ, বিশষী এভং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির পুরষ্কারে পুরস্কৃত ।
এই তিনটি বই একত্রে প্রকাশ করে পাঠকদের কিছুটা হলেও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে এনে তাঁদের হাতে তুলে দিতে পেরেছি বলে আমরা আনন্দিত।
সমরেশ মজুমদার
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের জন্ম ১০ মার্চ ১৯৪৪।
তাঁর শৈশব এবং কৈশাের কেটেছে জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সের চা বাগানে। লেখাপড়ায় মন বসতাে না একদমই। ইচ্ছে ছিল নায়ক হবেন। তাই জলপাইগুড়ির বন্ধুদের নিয়ে সাজাতেন নাটকের দল। বাজারের জন্য দিদিমার দেয়া টাকা বাঁচিয়ে তাও খরচ করতেন বন্ধুদের নিয়ে। ষােলাে বছরের এক তরুণ সমরেশ কলকাতায় আসেন ১৯৬০ সালে। ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজে, বাংলায়। এখানেও শুরু হলাে থিয়েটার আর নাটক লেখা, গল্প লেখার কাজ। নাটক লিখলেও নাটক হতাে না। অভিনয়ও জমছে না ঠিকমতাে। ততদিনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাসের সার্টিফিকেট জুটলাে কপালে। কিন্তু নায়ক হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হলাে না। এবার নাটক বাদ। গল্প লেখায় সময় ব্যয়। ১৯৭৬ সালে দেশ পত্রিকায় ছাপা হলাে তাঁর প্রথম উপন্যাস দৌড়। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রকাশিত গ্রন্থ ২১৫।
সমরেশ মজুমদার ১৯৮২ সালে পান ‘আনন্দ পুরস্কার'। কালবেলা উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান ১৯৮৪ সালে।