“যুদ্ধের প্রথম শেলটা পড়ে হৃদয়ের মাঝখানে...” ‘পল বােমার'-এর এই আক্ষেপ আর হাহাকার যেন প্রতিধ্বনি তােলে আমাদের লিটল ফাইটারের কথায়..., আমার ছেলেখেলা করা শৈশব এক হ্যাচকা টানে সরে গিয়ে আমার সামনে হাজির হয়েছিল যুদ্ধের দগদগে ঘা মাখা এক কদাকার বীভৎস স্মৃতি, যা আনন্দ বেদনা আর গৌরবের এক রক্ত তিলক।
‘আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস, পরিণত বয়সে এসে পিছন ফিরে চাওয়া এক কিশােরের, কালের দৃষ্টিতে দেখা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে তার প্রথম কৈশাের কাটানাে মনজুরুল হক, লিটল ফাইটার হয়ে, আমাদের মনে করিয়ে দেন এরিক মারিয়া রেমার্ক, আমাদের স্মৃতিতে ভেসে উঠে তার ধ্রুপদি সৃষ্টি ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ ... যদিও বয়সের বিস্তর ফারাক বিদেশি সাংবাদিকের ক্যামেরায় তােলা গােলাবারুদের আশ্রয়ের মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা লিটল ফাইটার আর রেমার্কের পল বােমারের মধ্যে।
এরিক মারিয়া রেমার্কের সৃষ্ট অমর চরিত্র পল বােমার যুদ্ধে গিয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সে, আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের হাত থেকে নিজ পরিবার আর মাতৃভূমিকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞায় আমাদের লিটল ফাইটার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন মাত্র ১১ বছর বয়সে। যুদ্ধের বিভীষিকার মাঝে আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে বেড়ানাে একটা পরিবার বিদেশ বিভূঁইয়ের অচেনা পরিবেশে এসে হাবুডুবু খায়, এই অবস্থায় পুরাে পরিবারকে একরকম মাঝপথে ফেলে রেখে পরিবারের প্রধানকে দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে তার দায়িত্ব পালনের জন্য ফ্রন্টে ফিরে যেতে হয়। ছােট তিন বােনসহ আম্মার দায়িত্ব এসে পড়ে, লিটল ফাইটারের ১১ বছরের কাঁধে, ‘ভয় পেয়াে না, তােমার ওপর দায়িত্ব থাকল, নিজে বাঁচবে, মা-বােনদের বাঁচাবে...' পিতার আদেশ শিরােধার্য করে অনাত্মীয় বিদেশের মাটিতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এক অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করে এক নাবালক কিশাের। শুরু হয় যাবতীয় প্রতিকূলতার মাঝে নিজ পরিবারকে নিয়ে স্রেফ টিকে থাকার জন্য, হাফপ্যান্ট হাওয়াই শার্ট স্যান্ডেল পায়ে ঘাড়ে ব্যাগ, ১১ বছরের এক কিশােরের দাঁতে দাঁত চেপে এক মরিয়া লড়াই... আমাদের লিটল ফাইটারের নিজস্ব লড়াই।
মনজুরুল হক
সাধারণ অর্থে লেখক পরিচিতির ভেতর যেমন বেশ ওজনদার একটা ব্যাপার থাকে আমার ক্ষেত্রে সে সবের বালাই নেই। খুলনা জেলার একটি গ্রামে সাধারণ আর দশ জনের মতাে সাধারণ পরিবারে জন্ম। বাবা-মায়ের থাকতে পারে, তবে আমার বিশাল কিছু হবার স্বপ্নটপ্ন ছিল না । জন্মের পর ঊনপঞ্চাশটি বছর পার হয়ে গেছে। কী করেছি আর কী করতে পারিনি তারও কোনাে খাতওয়ারি পরিসংখ্যান নেই। স্বপ্ন না থাকলেও ইচ্ছা ছিল, আর সেই ইচ্ছাটি অঙ্কুরিত হয়েছিল ঘুড়ি ওড়ানাের, লাটিম ঘােরানাের বয়সে চরম বাস্তবতায়। মুক্তিযুদ্ধে আমার সহযােদ্ধা বাবা গত হয়েছেন। আছেন মা, চার ভাই বােন, স্ত্রী আর ফুটফুটে দুটি কন্যা। বিকলাঙ্গ ক্ষয়ে যাওয়া সমাজটাকে আমূল বদলে দেয়ার যে ব্রত কৈশােরে-যৌবনে পাগলা ঘােড়ার মতাে দাবড়ে ফিরেছে, আজও সেই ছুটে চলা থেমে যায়নি। আজও বুকের গভীরে সযতনে লালিত সেই ভেঙেচুরে নতুন নির্মাণের সুতীব্র বাসনা। আস্থায় মাটি ও মানুষ চেতনায় মাকর্সবাদ ধারণ করে এখনাে স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখি-একদিন ঠিক পেরে যাব।