বাহাদুর বোঝে কম। সবাই তাই বলে। কোনটা কম বোঝে এটাই সে বুঝতে পারে না। তবে এই কম বোঝা কথাটি শুনতে তার ভালোলাগে না। বাহাদুরের বাড়ি গ্রামে। বয়স ১০-১১ বছর। ওর ছোট বোন বুবাই সারাক্ষণ তাকে ভাই ভাই বলে মুখে ফেনা তোলে। বাহাদুর যদি কমই বুঝত তাহলে বুবাই তাকে এত এত ভাই বলে ডাকতো?
বাহাদুর মোটেও কম বোঝে না। সে মেঠোরাস্তায় সারিবদ্ধ কুকুর দেখে ভয় পায় না। এমনকি শীতের রাতে থেকে থেকে শিয়ালের হাককেও সে ভয় পায় না। বরং কুকুরের লড়াই তার বড্ড ভালোলাগে। বাবা-চাচারা ধারি ধারি গেছো ইঁদুর বা বেজির বাচ্চা ধরতে পারলে খাঁচায় ভরে সে খেলতেও বড্ড ভালোবাসে। কেউ কম বুঝলে এসব করতে পারতো?
বাহাদুরদের বাড়ির আঙিনার এক কোণে রান্নাঘর। ওদের খড়িতে রান্না হয়। দাদা-দাদি, চাচা-চাচি সবাইকে নিয়ে তাদের যৌথ পরিবার। পরিবারের সদস্য ১০-১২ জন। এতজনের রান্না-বান্না করার পর চুলার আগুন গনগন করে। তখনও আগুনের বড্ড তেজ। বাড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে। কেউ যদি চুলায় পড়ে তাহলে অঘটন ঘটে যাবে। তাই রান্নার পর চুলাতে পানি ঢেলে আগুন নিভে দেয়া হয়।
একদিন রান্নার পর পাশের পাতিলটি চুলায় দেয়ার জন্য বাহাদুরকে বলা হলো। সে পাতিলের পানি চুলায় ঢেলে দিল। এতে সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। অবাক হবার মত এমন কি কাজ সে করেছে! সে বুঝতে পারে না। মা যখন লাঠি নিয়ে তেড়ে আসছিল তখন বুঝতে পেরেছে- পাতিলে থাকা দুই লিটার দুধ সে চুলায় ঢেলে দিয়েছে। বাবা অবশ্য মাকেই ধমক দিয়ে বলে- ওর কি দোষ! ওকে বলেছ কেন? জানোই তো বাহাদুর কম বোঝে!
বর্ষার ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির দিনে মা ডেকে বললো- আজকে আর ছাগলগুলো বাইরে নিয়ে কাজ নেই। ছাগলের যা স্বভাব! বৃষ্টির পানি গায়ে পড়লেই বাড়ির দিকে দৌড়ে ছুটে আসবে। কোণের বড় ঘরটি সে সময় হাঁস-মুরগি আর ছাগলের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সেদিন হাঁস-মুরগি বাইরে যাবার জন্য কোণের ঘরের দরজা অল্প সময় খুলে দেয়া হলেও ছাগল যাতে বাইরে যেতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হলো।
ওদিকে বাড়ির পটকাপটকি মুরগিটা সবে ডিম ফুটিয়ে ১১টা বাচ্চা তুলেছে। হাঁসগুলো পাক পাক করতে করতে বাইরে ছুটে গেল। মুরগিগুলোও কক কক শব্দ তুলে বাইরে গেলেও মুরগির মা তার বাচ্চাগুলো নিয়ে ঘরেই রয়ে গেল। দরজা পুনরায় বন্ধ হয়ে গেলেও জানালাগুলো খোলা থাকল। ঘরের মধ্যে থোকায় থোকায় কাঁঠাল পাতা দড়িতে বেঁধে রাখা হলো। ছাগলগুলো কাঁঠাল পাতা পেয়ে বাইরে বেরুবার দুঃখ ভুলে গিয়ে কচমচ শব্দে কাঁঠালের কচি পাতা চিবাতে থাকল।
সকাল গিয়ে দুপুরে ঠেকলে মা বাহাদুরকে ডেকে ছাগলকে পানি দিতে বলে। সবারই পিপাসা নিবারণের প্রয়োজন আছে। মালশা ভরে ভাতের ফেনার সাথে এঁটো-ঝুঁটা পানি বাহাদুরের দিকে মা এগিয়ে দেয়। আর পই পই করে বলে দেয়- সে যেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ছাগলকে পানি খাওয়ায়। কে শোনে কার কথা! বাহাদুরের ছটফটে মন। সে এক জায়গায় স্থির থাকার বান্দাই নয়। কোণের ঘরে পানির মালশা রেখে বাহাদুর ছুটে পালায়। এদিক সেদিক ছুটাছুটিই তার প্রধান কাজ।
দুপুর গড়িয়ে গেলে আকাশে আলো ফুটে উঠলো। ছিপছিপে বৃষ্টিরা সেই আলোতে হারিয়ে গেল। মা- বাহাদুর, বাহাদুর বলে ডাক পারে। ছাগলগুলোকে বাইরে আনা দরকার। সারাদিন ঘরের মধ্যে বন্দি থেকে ওরা অস্থির হয়ে পড়েছে। বাইরের বাতাসে খানিকটা ঘুরে আসুক। মায়ের ডাক শুনে বাহাদুর দৌড়ে এসে দরজা খুলে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কিছু বুঝার আগেই বাহাদুর বাড়ি ছেড়ে পালায়। মা এসে দেখে- হায়, কি কাণ্ড! বাহাদুর একি সর্বনাশ করেছে! মায়ের চিল্লানিতে কোণের ঘরে বাড়ির সবাই জড়ো হয়। হায় আল্লাহ! মালশা ভর্তি পানিতে মুরগির সদ্য ফোটা বাচ্চাগুলো মরে ভাসছে। মা মুরগিটা কুচ কুচ শব্দ করছে আর মালশার চারপাশে ঘুরছে।
বাবার একটি বাইসাইকেল ছিল। চায়না ফনিক্স সাইকেল। পুরোনো সাইকেলটি হাটে-বাজারে যাতায়াতসহ জমিতে এটা-সেটা আনা-নেয়া কাজে ব্যবহার হতো। বাবা সাইকেলের সামনের রডে গামছা পেচিয়ে সেখানে বাহাদুরকে বসিয়ে এখানে সেখানে নিয়েও যেত। তাকে পেছনের ক্যারিয়ারে না নেয়ার কারণ হলো সে কম বোঝে। পেছনের ক্যারিয়ারে বুবাইয়ের বসার সুযোগ হলেও বাহাদুরের সে সুযোগ এখনও হয়নি।
একদিন বাহাদুর বাবার সাইকেলে বসে শহরের হাটে গেল। সুবলের পানের দোকানে তাকে বসিয়ে রেখে বাবা সেই কখন সদাই কিনতে গেছে। বাহাদুরের উপর দায়িত্ব ছিল পাশে রাখা সাইকেলটি দেখে রাখা। সে সাইকেলের উপর বরাবর চোখ রেখেছে। সেখানে একটা সাইকেল দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। বাবা এলে জানা গেল এটা ওদের সাইকেল নয়। তাদের সাইকেল চুরি হয়েছে। একই রকম সাইকেল একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেদের সাইকেল ভেবে বাহাদুর ভুল করেছে। বাবা অবশ্য তাকে এ নিয়ে কোনো বকাঝকা করেনি।
গ্রামে একদিন এক যাদুকর এলো। মজার মজার কত খেলা দেখালো। বাহাদুর যাদুকরের যাদু খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। হাতের মুঠির মধ্যে পাখির কিচির মিচির শব্দ। ছোট ছোট গোরু-ছাগল-বউ! সব কেমন স্বপ্নের মত। বাহাদুর সবাইকে বলে দিল- সে যাদুকর হতে চায়। সবাই তো হেসেই কুটি কুটি। বাবা বললো- ওসব ভেলকি বাজি! যাদু বলে কিছু নেই। এই কথাটি বাহাদুরের মাথায় ঢুকছে না। যাদু বলে যদি কিছু না-ই থাকবে তবে গোরু-ছাগল-বউ ওসব কেমনে এলো?
বাহাদুর ছোট বোন বুবাইকে তার ইচ্ছের কথা জানালো। বুবাই কথাটি শুনে অনেক মজা পেল। সেও চায় ভাই যাদুকর হোক। সে ভাইকে উৎসাহ দিল। বুবাইয়ের উৎসাহ পেয়ে বাহাদুর ভাবতে থাকে। কিভাবে যাদুকর হওয়া যায়! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মাথায় এলো- এই যে দিনের বেলা এত এত আলো। রাত এলেই সব আলো শেষ। অন্ধকার আর অন্ধকার। এমন ভাবতে ভাবতে সে চোখ বন্ধ করে। সবকিছু অন্ধকার। চোখ খুলে তাকালে আবার আলোই আলো। বাহ্ এই তো যাদু! চোখ খোলো দিন, চোখ বোজো রাত!
বাহাদুর বুবাইয়ের কাছে ছুটে যায়। আনন্দে বোনকে জড়িয়ে ধরে জানায়- সে যাদুকর হয়ে গেছে। এখন সে যাদু দেখাতে পারে। বোনটিও আনন্দে চিল্লাইতে থাকে আর বাড়ির সবাইকে ডাকে। ভাই যাদু শিখেছে, জলদি এসো, ভাই যাদু শিখেছে। বাড়ির সবাই তাদের আঙিনায় এসে দাঁড়ালে বাহাদুর তার দিনরাতের যাদুটি দেখিয়ে দিল। সবাই তাকে হাততালি দিয়ে উৎসাহ জানালো।