মুর্তজা বশীর আমার প্রিয় লেখক, কারণ। তিনি নির্ভীক। তিনি স্পষ্ঠভাষী। তিনি সত্যদর্শী। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে, দর্শকের দৃষ্টিতে জীবনকে প্রত্যক্ষ করেন না। জীবনের অনু-পরমাণুতে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে আধুনিক মানুষের মন, মনন, হৃদয়, আবেগ, অনুভূতি, ঈর্ষা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, লোভ, লালসা, প্রেম, দ্বন্দ্ব, বিকার, বিড়ম্বনা, সব কিছুকে তীব্র তীক্ষ বিশ্লেষণের মাধ্যমে, একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিতে, পাঠকের সামনে উপস্থিত করেন। কাচের পাখির গান তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। এতে মোট বারোটি গল্প স্থান পেয়েছে। কিছু গল্প যেমন, হাতঘড়ি, সমকোণ, অনাময়, রোগ এগুলো তাঁর প্রথম যখন কলম ধরেছিলেন তখনকার লেখা। মাঝে দীর্ঘ দিন লেখার জগৎ থেকে দূরে সরে ছিলেন। ফিরে এসে লিখলেন, সাদা হাতী, পোকা, শকুন, কাচের পাখির গান, কায়েকটি রজনীগন্ধা, বিবমিষা, ঘুণ। প্রতিটি গল্প আধুনিক জীবনবোধের উজ্জ্বল প্রতীক। বক্তব্যের বলিষ্ঠতায়। উপস্থাপনার অভিনবত্বে এবং উপলব্ধির গভীরতায় সমকালীন সাহিত্যে মুর্তজা বশীর এক অনন্য স্থান অধিকার করে নিয়েছেন। মুর্তজা বশীর একজন ণিঃসঙ্গ মানুষ। নিঃসঙ্গ চিত্রকর। নিঃসঙ্গ লেখক। তাঁর জীবনের এই নিঃসঙ্গতার অন্ধকারের মধ্যে থেকেও তিনি চান হীরের মতো উজ্জ্বল দ্যুতি। তিনি মানুষকে ঘৃণা করেন। ঘৃণা করেন বলেই হয়তো তাদেরকে গভীরভাবে ভালবাসতেও জানেন। আর এইটাই হচ্ছে মুর্তজা বশীরের রচনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ঠ্য। -জহির রায়হান।/ মুর্তজা বশীর। এই নামটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে নিরলস সাধনার এক ইতিহাস। অসাধারণ তিনি বরাবরই অগতানুগতিক। চলায় বলায়, কি শিল্প প্রয়াসেÑসর্বত্রই তিনি স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত। প্রথম দর্শনে মনে হ’তে পারে উচঁ কপালে, দাম্ভিক, রাগী এক পুরুষ। কিন্তু পরিচয়ের প্রাথমিক বেড়া ডিঙিয়ে গেলে যে শিল্পী মানুষটির দেখা মেলে তিনি প্রকৃতই কোমলমধুর এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এতদিন তাঁকে আমরা জানতাম এ দেশের প্রতিভাবান চিত্রকর গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান হিসেবে, যিনি এ যুগের গোধূলি সঙ্কটে জ্বলছেন দীপের মতো; আর এই গল্পগ্রন্থে আমাদের সাহিত্য-ক্ষেত্রেও তাঁর জন্য পাকা করে নিলো জ্বলজ্বলে একটি আসন। প্রথা-বিদ্বেষী এই শিল্পী এমন কিছু গল্প রচনা করেছেন যা আমাদের সাহিত্যে আনকোরা স্বাদ নিয়ে এসেছেন। আধুনিক মানুষের মনে যেসব অতল খাদ রয়েছে, রয়েছে চোরা নদী তারই সন্ধান দিয়েছেন তিনি, সেই জটিল-গভীর জগতের আলো অন্ধকারে তিনি রূপায়িত করেছেন নিপুণ নিষ্ঠায়।
মুর্তজা বশীর
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র কনিষ্ঠ সন্তান মুর্তজা বশীর (জন্ম ১৯৩২)। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অফ আটর্স্ (বর্তমানে চারুকলা ইন্সটিটিউট) থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ ম্যুজিয়ম থেকে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট (আর্ট এ্যাপ্রিসিয়েশন) লাভ করেন। ১৯৫৬-৫৮ সালে ইতালীর ফ্লোরেন্সে একাদেমী দ্যেল বেল্লে আরটিতে চিত্রকলা ও দেয়াল চিত্র বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৭১-৭৩ সালে প্যারিসের ইকোলে ন্যাশিওনাল সুপিরিয়্যর দ্য বোজার্ট ও আকাদেমী গোয়েৎস-এ মোজাইক ও ছাপচিত্র বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রণে একমাসের জন্য আমেরিকায় আটটি ষ্টেটের বিভিন্ন ম্যুজিয়ম পরিদর্শন করেন। ১৯৬৩ সালে উর্দু চলচ্চিত্র কারোয়াঁর কাহিনী ও চিত্রনাট্য এবং ১৯৬৪ সালে নদী ও নারী চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা ও শিল্প নির্দেশনা করেন। ১৯৭৯ সালে তাঁর উপন্যাস আলট্রামেরীন এবং ২০০১ সালে নির্বাচিত রচনাবলী নিয়ে মুর্তজা বশীর: মূর্ত ও বিমূর্ত শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশ হয়। ১৯৮৯-৯৩ বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল অফ্ দ্য নিউমিসম্যাটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়াতে প্রাক-মুঘল যুগে বাংলার সুলতানদের শাসন আমলে প্রচলিত মুদ্রা বিষয় গবেষণাধর্মী একাধিক মূল্যবান নিবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল ফেলোশীপে দু’মাসের জন্য লন্ডনে যান এবং ১৯৮৮ সালে ভারতের আই.সি.সি.আর ফেলেশীপে দিল্লী, বেনারস ও কলকাতার বিভিন্ন জাদুঘরে ‘বাংলা চিত্রকলার ঐতিহ্য’-এর ওপর গবেষণা করেন। ১৯৯৩ ও ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে পুনরায় আই.সি.সি.আর-এর অনুদানের ‘মন্দির টেরাকোটা শিল্প’-এর ওপর পশ্চিম বঙ্গের প্রায় তিনশত গ্রামে সরজমিনে পর্যবেক্ষণ করার জন্য মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান করেন। চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৮০ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন এবং ১৯৯৮ সালে প্রফেসররূপে অবসর গ্রহণ করেন।