গল্প হলেই ছােটগল্প হল না। গল্পটির একটা কৌতূহলােদ্দীপক আরম্ভ থাকতে পারে, থাকতে। পারে একটা চমকপ্রদ অন্তও। কিন্তু গল্পের ভেতরে অন্তর্বয়ান, কিংবা বিভিন্ন তাৎপর্যের বিবিধ স্তর, অথবা মানবপ্রকৃতির প্রতি কৌণিক দৃষ্টি না-থাকলে, বা অভিনব কোনাে অভিমুখ কিংবা জগজ্জীবনে মানবেরস্থিতির বিষয়ে বিচিত্র কিছু আলােকপাত না থাকলে সেটা গল্পই থেকে যাবে, ছােটগল্পের পরিভাষাটি পাবে না। বিশেষ কোনাে আবেগী বা মােহের বশে হয়ে-যাওয়া কোনাে ছােটগল্পের সীমা অতিক্রম করে মহৎ কোনাে ছােটগল্পকারও যদি গল্পের দেশে চলে যান, তবে ওটি আর ছােটগল্প থাকবে না। এর মানে ছােটগল্পে ঘটনা থাকবে না তা কিন্তু নয়। ঘটনা অবশ্যই থাকতে পারে, তবে ওটা নিছক কাহিনীতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। অপরপক্ষে ঘটনা পরিহার করেও যদি একটি বিশেষ ভাব বা মুডের মধ্যেই একটি মহামুহুর্তের উদ্ভব কোনাে লেখক তার গল্পে ঘটাতে পারেন—তবে সেটাও সার্থক ছােটগল্প হতে পারে বইকি। অবশ্য প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, আমার মতে ছােটোগল্প প্রথমে গল্প হওয়া চাই তার পরে ছােটো হওয়া চাই; এ ছাড়া আর-কিছুই হওয়া চাইনে। ইত্যাকার যাবতীয় কথাই পাঠকের মনে জাগতে পারে, এই গ্রন্থে সঙ্কলিত গল্পগুলাে পড়বার সময়।
সৈয়দ মুজতবা আলী
সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সালে, সিলেটের করিমগঞ্জে। পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী। শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতক ১৯২৬-এ। এরপর আফগানিস্তানে কাবুলের শিক্ষাদপ্তরে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় অধ্যাপক হিশেবে যােগ দেন। দুবছর পরে স্কলারশিপ নিয়ে যান জার্মানির বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৩২ সালে। ইউরােপ, এশিয়া ও আফ্রিকার নানা দেশে কর্মসূত্রে সঞ্চয় করেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ১৯৩৪-৩৫ সালে পড়েন কায়রাের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর বরােদায়। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপনায় যােগ দেন। দেশ বিভাগের পরে চলে আসেন জন্মভূমি তকালীন। পূর্ব-পাকিস্তানে ১৯৪৭ সালেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে বক্তৃতা করেন সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। ১৯৪৯-এ অধ্যক্ষ হিসেবে যােগ দেন বগুড়া আজিজুল হক কলেজে। এখানে থাকাকালীন বাংলাভাষার সমর্থনে লেখেন পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' শীর্ষক প্রবন্ধ। সরকার কৈফিয়ত তলব করলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ফিরে যান ভারতে। স্বল্পসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি চাকরি শেষে যােগ দেন আকাশবাণীর উচ্চপদে, পরবর্তীতে বিশ্বভারতীর ইসলামি সংস্কৃতির প্রধান অধ্যাপক হিসেবে। সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন বহুভাষাবিদ। ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান ইত্যাদি ইউরােপীয় ভাষা ও আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত, গুজরাটি, মারাঠি ইত্যাদি প্রাচ্য ও ভারতীয় সহ মােট পনেরােটি ভাষা জানতেন তিনি। বহু ভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা রসরচনায় মৌলিক অবদানের জন্য অবিস্মরণীয়। উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ ‘দেশে বিদেশে’, ‘শবৃনম’, ‘ময়ূরকণ্ঠী’, ‘হিটলার’, ‘চাচা কাহিনী', ‘ধূপছায়া’, ‘জলে ডাঙায়’, ‘মুসাফির’, ‘পঞ্চতন্ত্র, ‘অবিশ্বাস্য’, ‘ভবঘুরে ও অন্যান্য’, ‘টুনিমেম', ইত্যাদি। ১৯৪৯-এ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নরসিংহদাস সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত হন। বাংলাদেশে ফেরেন ১৯৭২-এ ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪-এ জীবনাবসান বাংলাদেশেই। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিশেবে পান একুশে পদক ২০০৫ (মরণােত্তর)।