"বাংলাভাষা : রাজনীতির আলোকে"বইটির মুখবন্ধ:
এই গ্রন্থে স্থানপ্রাপ্ত রচনাগুলাে উনিশশ' একাত্তর থেকে চুয়াত্তর সাল পর্যন্ত প্রসারিত সময় সীমার মধ্যেই লিখিত। একমাত্র বাংলার সাহিত্যাদর্শ' রচনাটি একাত্তরের যুদ্ধের পূর্বের । বাংলা একাডেমীর তৎকালীন পরিচালক জনাব কবীর চৌধুরীর আগ্রহে একাডেমীর। ষান্মাষিক ইংরেজি পত্রিকা Bengali Literature-এ প্রকাশের জন্য Literary Ideals in Bengal শিরােনামে একটি রচনা লিখি। বাংলা একাডেমীর ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত সে রচনাটি পরে অনুবাদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকায় প্রকাশ করি। এ ছাড়া অন্যান্য রচনাগুলাে যুদ্ধের পরের। জীবনানন্দ দাশ : তাঁর কাব্যের লােকজ উপাদান : সাম্প্রতিক নিরিখ প্রবন্ধটি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবির কর্তৃক আয়ােজিত জীবনানন্দ দাশের জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়ােজিত তিনদিন ব্যাপী আলােচনা সভায় তৃতীয় দিনে পাঠ করি। পরে লেখাটি সেলিনা হােসেন সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন ‘স্মারকে' মুদ্রিত হয়। তারও পরে সাপ্তাহিক গণবাংলায় দ্বিতীয়বার লেখাটি প্রকাশ পায়। ভাষা বিষয়ক চিন্তাভাবনা অধুনালুপ্ত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ১৯৭৪ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন ‘জাতিস্মরে’ প্রকাশিত হয়। একেবারে প্রথম প্রবন্ধটি লিখি ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে। যে পত্রিকাতে লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল, নানাকারণে তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি ঘটায় অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার রবিবাসরীয় সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ সংস্কৃতি শিবির’ আয়ােজিত তিনদিন ব্যাপী আলােচনা সভায় লেখাটি প্রথমবার পাঠ করি এবং দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি’ আয়ােজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাভাষায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চা শীর্ষক অধিবেশনে পাঠ করি।
গ্রন্থাকারে লেখাগুলাে প্রকাশিত হবার সময় সংশ্লিষ্ট পত্রিকা এবং সংকলনের সম্পাদকবৃন্দের প্রতি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা নিবেদন করছি। তাছাড়া বাংলাদেশ লেখক শিবির এবং বাংলাদেশ সংস্কৃতি শিবিরের কর্মীবৃন্দ, যাঁরা কঠোর পরিশ্রম করে চিন্তা-চেতনার দিগন্ত প্রসারী নৈরাজ্যের যুগে এ দেশের গণমানুষের সংস্কৃতিকে বিকাশমান করে তােলার জন্য, সহস্র ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে আলােচনা সভাগুলাের আয়ােজন করতেন, তাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মামুলি সৌজন্য প্রকাশের নয়। তাদের প্রতীক্ষার দুঃখদাহন এখনাে শেষ হয়নি। ‘বাংলার সমাজ বিপ্লবের প্রথম শােণিত বাংলাভাষার শরীর থেকেই নির্গত হবে’ প্রথম প্রবন্ধের এই শেষ বাক্যটি আমার বিদেশপ্রবাসী বন্ধু ফরহাদ মজহারের কোন একটি লেখা থেকে ধার করেছি। চার-পাঁচ বছরের পরিধিতে লেখা হলেও চারটি প্রবন্ধের মধ্যেই একটি মূলসুর— একটি দৃষ্টিকোণ মনােযােগী পাঠকের দৃষ্টি এড়াবে না বলে ভরসা করি ।
আহমদ ছফা
আহমদ ছফার জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চান্দনাইশ থানাধীন গাছবাড়িয়া গ্রামে, এক কৃষিজীবী পরিবারে। বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। স্কুল ও কলেজের লেখাপড়া যথাক্রমে চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন, যদিও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। সমাজবিজ্ঞান নিয়ে কিছুদিন পদ্ধতিগত গবেষনা করেন। কিন্তু অচিরেই তা ছেড়ে দিয়ে মৌলিক রচনা ও চিন্তাচর্চায় আত্মনিবেশ করেন। মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য সাংবাদিকতা, পত্রিকা প্রকাশ, প্রেস ব্যবসা বা এনজিও কার্যক্রমকে পেশা হিসেবে নিলেও, আজীবন লেখালেখিই ছিল তার মূল কাজ। ছাত্রাবস্থায়ই লিখেছিলেন সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, যদিও তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই একটি উপন্যাস সূর্য তুমি সাথী। প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, অনুবাদ-কর্ম, শিশু-কিশাের সাহিত্য ইত্যাদি মিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিরিশের অধিক। তাঁর পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় ও ‘বস্তি উজার কবিতাটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ ছাড়া ওঙ্কার সহ বেশ কিছু লেখা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ওঙ্কার উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। তিনি বেশ কিছু গানও লিখেছেন। গ্যোতের ফাউস্ট কাব্যনাট্যের বঙ্গানুবাদ তাঁর এক অমর কীর্তি। প্রতিষ্ঠানবিরােধী ও প্রতিবাদী বক্তব্যের জন্য আজীবন তিনি ছিলেন আলােচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রে। পাশাপাশি নতুন প্রতিভা আবিষ্কার ও তার লালন এবং নবীনদের মধ্যে চিন্তা উসকে দেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর জুড়ি ছিল না। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, যদিও এই সংগঠনের দেওয়া পুরস্কারও তিনি গ্রহণ করেন নি। সমাজের বঞ্চিত শিশুদের জন্য শিল্পী সুলতান পাঠশালা প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম কীর্তি। মৃত্যু : ২০০১ সালের ২৮ শে জুলাই, ঢাকায়।