বিষাদ-সিন্ধু (১৮৮৫-৯১) নিয়তি-লাঞ্ছিত মানবভাগ্যের এক মর্মস্পর্শী গদ্য-মহাকাব্য। শিল্পবোধ, জীবনানুভূমি ও ভাষাসৌকর্যে বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী গ্রন্থ বিষাদ-সিন্ধু মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১১) স্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি হিসেবে বিবেচিত। মীরের অসামান্য লোকপ্রিয়তা ও ব্যাপক পরিচিতির মূলেও আছে এই বইটি। কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই উপাখ্যানের কাহিনি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এজিদের সঙ্গে হাসান-হোসেনের বিবাদ-বিরোধ রাজনৈতিক, রাষ্ট্রক্ষমতার দখলই এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ। কিন্তু বিষাদ-সিন্ধুতে এই বৈরিতার মূল কারণ হিসেবে এজিদের জয়নাব-লাভের তীব্র কামনাই চিহ্নিত হয়েছে। এজিদই বিষাদ-সিন্ধুর প্রধান চরিত্র। তার কামনা-বাসনাকে কেন্দ্র করেই এই উপন্যাসের সূচনা এবং তার শোচনীয় বিপর্যয়েই এই কাহিনির সমাপ্তি। বিষাদ-সিন্ধুর সঙ্গে হোমারের ইলিয়াড-এর কাহিনির বিশেষ সাদৃশ্য আছে। সেখানেও এক রমণী, হেলেনের কারণেই ঘটে যায় গ্রিক ও ট্রোজনদের মধ্যে বিনাশী সমর, রচিত হয় মানবিক বিপর্যয়ের এক মর্মান্তিক ট্রাজেডি।
বিষাদ-সিন্ধু সেকালে পাঠক ও সমালোচকমহলে বিশেষ সমাদৃত হয়। ‘প্লাবনী করুণা রসে টলটল’ বিষাদ-সিন্ধু অক্ষয়চন্দ্র সরকারকে ‘বিচলিত’ করেছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই বই সম্পর্কে 'ঙহব ড়ভ ঃযব নবংঃ ড়িৎশং রহ ঃযব ইবহমধষর খধহমঁধমব' বলে মন্তব্য করেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিষাদ-সিন্ধুকে বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস-এর সঙ্গে তুলনা করে এক ‘জাতীয় মহাকাব্য’, ‘বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ’ হিসেবে অভিহিত করে মন্তব্য করেছেন,‘তাঁহার সাহিত্য-প্রতিভা এমনই উচ্চশ্রেণীর ছিল যে, সুদূর অতীতের কারবালা-প্রান্তরের ট্রাজেডিকে তিনি সমগ্র বাংলাভাষাভাষীর ট্রাজেডি করিয়া তুলিতে পারিয়াছেন।’
বিষাদ-সিন্ধু বইটি মশাররফের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আকর ও প্রামাণিক গ্রন্থ-রচিয়তা ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরীর সম্পাদনার প্রকাশিত হলো। দীর্ঘ ভূমিকা, গ্রন্থ-পরিচিতি ও বিষাদ-সিন্ধু সম্পর্কে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধের সংকলন বিষাদ-সিন্ধুর বর্তমান সম্পাদিত সংস্করণটিকে সমৃদ্ধ ও গুরুত্ব-দান করেছে।
মীর মশাররফ হোসেন
মীর মশাররফ হোসেন (নভেম্বর ১৩, ১৮৪৭ - ১৯১২) ছিলেন একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক যিনি ঊনবিংশ শতাব্দাীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা গদ্যের ঊণ্মেষকালে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি বিষাদ সিন্ধু নামক ঐতিহাসিক রচনার জন্য সপুরিচিত ও সাধারণ্যে জনপ্রিয়। তিনি তৎকালীন বৃটিশ ভারতে (বর্তমান বাংলাদেশ) কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের লাহিনীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখাপড়ার জীবন কাটে প্রথমে কুষ্টিয়ায়, পরে ফরিদপুরের পদমদীতে ও শেষে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে চাকরি করে। তিনি কিছুকাল কলকাতায় বসবাস করেন। মীর মশাররফ হোসেন তাঁর বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন। সাহিত্যরস সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনায় তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে লেখা উপন্যাস "বিষাদসিন্ধু" তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। তাঁর সৃষ্টিকর্ম বাংলার মুসলমান সমাজে আধুনিক সাহিত্য ধারার সূচনা করে। মীর মশাররফ হোসেন খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর একটি ছোট গ্রাম লাহিনিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তার জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির পদমদীতে অতিবাহিত করেন। তবে তার জন্ম তারিখ ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর বলে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। কিন্তু কিছু গবেষক তার জন্ম তারিখ ১৮৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর বলে দাবী করেন। তিনি মীর মোয়াজ্জেম হোসেন (মুসলিম সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি) এবং দৌলতুন্নেছার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র আঠার বছরে বয়সে তারঁ পিতৃবন্ধুর কন্যা আজিজুন্নেসার সাথে বিয়ে হয়। ১৯১২ সালে দেলদুয়ার এস্টেটে ম্যানেজার থাকাকালেই মীর মশাররফ হোসেন পরলোকগমন করেন। তাকে পদমদীতে দাফন করা হয়।