সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের একটি সিরিজ প্রকাশনা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আখ্যায়িকার শুরু, এ-কথা বলা যায়। ১৮৫৪ সালে তিনি কবি কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের উপাখ্যানভাগ বাংলায় পরিবেশন করেন। এরপর প্রায় শতবর্ষ ধরে বাংলা কথাসাহিত্যের যে-বিকাশ তার শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থগুলেকে পাঠকের কাছে একত্রে তুলে দেওয়ার আকাক্সক্ষা নিয়েই সিরিজটি পরিকল্পিত হয়েছে। সারা বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালার ২৪টি বই একসঙ্গে পাওয়া অত্যন্ত খুশির বিষয় হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আগামীতেও এরকম কিছু গ্রন্থ পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারবো বলে আমরা আশা রাখি।
হানা ক্যাথেরীন ম্যলেন্স
হানা ক্যাথেরীন ম্যলেন্স (১৮২৬-৬১) রচিত ফুলমণি ও করুণার বিবরণ (১৮৫২) বইটির উল্লেখ বাংলা রচনার বিভিন্ন তালিকাগ্রন্থে পাওয়া যায়, কিন্তু মূল রচনাটি ছিল দুষ্প্রাপ্য। ১৯৫৮ সালে বিশিষ্ট গ্রন্থাগারিক ও প্রাবন্ধিক চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বইটি প্রকাশিত হলে বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হিসেবে এর দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। জানা যায়, লন্ডন মিশনারি সোসাইটির সুইস সদস্য রেভারেন্ড ফ্রাঁসোয়া লাক্রোয়া খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করতে ১৮২১ সালে চুঁচুড়ায় আসেন। তার পাঁচ বছর পর কলকাতায় তাঁর কন্যা হানা ক্যাথেরীনের জন্ম হয়। বাংলা ভাষা তিনি এতই ভালো আয়ত্ত করেন যে, মাত্র বারো বছর বয়েসে তিনি ভবানীপুর মিশনের স্কুলে দেশি খ্রিষ্টান ছেলেমেয়েদের বাংলা পড়াতেন। মিশনের অপর কর্মী জে. ম্যলেন্সের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি জেনানা মিশন স্থাপন করেন। ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান ট্রাক্ট অ্যান্ড বুক সোসাইটি থেকে ফুলমণি ও করুণার বিবরণ প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলের খ্রিষ্টানদের বিদ্যালয়ে তা পাঠ হয়। তবে বইটি ও তার রচয়িত্রী সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন যে রয়ে যায়, তাও সত্য। হানা ক্যাথেরীন কি বইটি নিজেই লিখেছিলেন, না অন্য কেউ তাঁর নামে লিখে দিয়েছিলেন? বইটি কি মূলে বাংলায় রচিত, না ইংরেজি অনুবাদ? ১৯৫৯ সালে আমি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগারের তাক থেকে একই লেখিকার বিশ্বাস-বিজয় নামে একটি বই খুঁজে পাই। সেটি ফুলমণি ও করুণার বিবরণের পরে প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু তা হানা ক্যাথেরীনের ইংরেজি রচনার বঙ্গানুবাদ। কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকায় তখন চিঠি লিখে আমি বইটির অস্তিত্বের সংবাদ দিই এবং প্রশ্ন করি যে, প্রথম বইটি বাংলায় লিখে থাকলে লেখিকা দ্বিতীয় বইটি ইংরেজিতে লেখার এবং তারপর ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন কেন? চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তার উত্তরে লেখেন যে, লেখিকা দ্বিভাষিক হয়ে থাকলে একটি বই এক ভাষায় এবং আরেকটি বই অন্য ভাষায় লেখা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। পরে সুকুমার সেন মিসেস ম্যলেন্সের আরো একটি বইয়ের সন্ধান দেন, সেটিও বাংলা অনুবাদÑপাদরি সাহেবের বজরা। ফলে লেখিকার বাংলা ও ইংরেজি মূল ও অনুবাদের প্রশ্নটির চূড়ান্ত মীমাংসা হলো না। ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায় ও সবিতা দাস (চট্টোপাধ্যায়) প্রমুখ গবেষকের অনুসন্ধান থেকে এখন জানা যাচ্ছে যে, ফুলমণি ও করুণার বিবরণ উপন্যাসটি মৌলিক রচনা নয়। এ-বিষয়ে তাঁদের বরাত দিয়ে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন যে, লন্ডনে প্রকাশিত অজ্ঞাতনামা লেখকের The Week নামে একটি ইংরেজি কথাসাহিত্য (তিন ভাগ একত্রে নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয় (১৮৭৩এ) থেকে আলোচ্য বাংলা বইটর আখ্যানভাগ গৃহীত হয়। বাংলা বইটি প্রকাশের পরপরই The Oriental Baptist সাময়িকপত্রে এই তথ্যটি উল্লিখিত হয়েছিল। বাংলা উপন্যভসের কাহিনি, চরিত্র ও সংলাপ ইংরেজি গ্রন্থ থেকে প্রায় হুবহু নেওয়া। তাহলে বলতে হবে, ফুলমণি ও করুণার বিবরণ বাংলা ভাষায় লিখিত প্রথম উপন্যাস; তবে মৌলিক নয়, অনুবাদমূলক। বইটি রচনার উদ্দেশ্য খ্রিষ্টীয় নীতিবোধ ও ধর্মীয় চেতনার প্রচার। এই উদ্দেশ্যপরায়ণতা উপন্যাসের শিল্পরূপকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কাহিনিতে ধারাবাহিকতা নেই, চরিত্রেরা প্রায়ই সাদা-কালো রঙে অঙ্কিত। ফুলমণি ভালো খ্রিষ্টান, তাই তার জীবন সার্থকতায় পরিপূর্ণ, স্বামী-সন্তানে সে সৌভাগ্যবতী। অপরপক্ষে করুণা ক্রিষ্টান হয়েও ধর্মবিষয়ে উদাসীন, তাই তার সংসারে শান্তি নেই, স্বামী মাতাল, সন্তানেরাও ভালো হয়ে ওঠেনি। পুত্রের আকস্মিক মৃত্যুর পরে করুণার অনুশোচনা জেগেছে, সে নিজে সৎ খ্রিষ্টান হওয়ার চেষ্টা করেছে এবং পরিণামে তার সংসারজীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভালো খ্রিষ্টানের দৃষ্টান্ত দেখে মুসলমান আয়াও খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়েই উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা একরৈখিক ও আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে। সংলাপ যে শুধু নীতিকথাবহুল, তা নয়, তাতে যেভাবে বাইবেল থেকে উৎসনির্দেশসহ উদ্ধৃতি ভরে দেওয়া হয়েছে, তাতে তা স্বাভাবিকতার সীমা অতিক্রম করে গেছে। তাহলে লেখিকার কৃতিত্ব কোথায়? এখন পর্যন্ত মনে করা হচ্ছে যে, উপন্যাসের ভাষা শ্রীমতী ম্যলেন্সেরই। সে-ভাষা যথার্থই চিহ্নিত হয়েছে কেরীর কথোপকথনের আদর্শ-অনুসারী বলে। নি¤œশ্রেণীর বাঙালির মৌখিক ভাষার প্রয়োগ একদিকে যথার্থ, অন্যদিকে খ্রিষ্টান ধর্মগ্রন্থের ‘উৎকট বৈদেশিকপন্থী বাগ্ধারা’র প্রচুর ব্যবহার লক্ষ করেও শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষার উপর লেখিকার অধিকার ‘সীমাবদ্ধ হইলেও প্রশংসনীয়’ বলে মন্তব্য করেছেন। লেখিকার একটি ঝোঁক খুবই চোখে পড়ে : স্ত্রীলিঙ্গে আ-প্রত্যয়ের বাহুল্য: অসন্তুষ্টা, আহ্লাদিতা, উপস্থিতা, উল্লাসিতা, ক্ষান্তা, জ্ঞাতা, তৃপ্তা, দুঃখিতা, দুর্বলা, ধার্মিকা, পীড়িতা, ভাবিতা, ভীতা, সন্তুষ্টা, সুস্থা। বইটি অনুবাদমূলক বলেই বাঙালি খ্রিষ্টান সমাজের যে-পরিচয় এতে ফুটে উঠেছে, তা কতটা মূল গ্রন্থ থেকে আহরিত এবং কতটা লেখিকার পর্যবেক্ষণজাত, তা বলা যাচ্ছে না। তবে উপন্যাস পাঠ করে এমন প্রীতি জন্মে যে, তিনি নি¤œবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ভালোই অভিজ্ঞতা অঙ্কন করেছেন। যেদিন মাতাল স্বামী ঘরে ফিরে স্ত্রীর কাছ থেকে তিরস্কারের বদলে অনুভূতি লাভ করল, সেদিন’ ‘করুণার এমত নূতন ব্যবহার দেখিয়া তাহার মাতাল স্বামী তাহাকে কিছু মাত্র চিনিতে না পারিয়া বিছানাতে শুইয়া আপনা আপনি বলিতে লাগিল, এ বেটী বড় ভাল মানুষ, ইহার ঘরে বরাবর আসিব।’ এখানে লেখিকার প্রশংসা না করে পারা যায় না। হানা ক্যাথেরীন ম্যলেন্সের কৃতিত্ব সম্পূর্ণরূপে এখনো নিরূপণ করা যায় না। সুকুমার সেন বলেছেন, বইটি আকারে ও প্রকারে উপন্যাসের মতো। বাংলা উপন্যাসোপম প্রথম আখ্যানরূপেই হয়তো ফুলমণি ও করুণার বিবরণ সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। -আনিসুজ্জামান বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল।
আনিসুজ্জামান
আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালে কলকাতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলায় বি এ অনার্স, এম এ ও পিএইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষকতা করেন দু-দফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৫৯-৬৯ ও ১৯৮৫-২০০৩) এবং মধ্যবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবসর নেওয়ার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক ছিলেন, এখন এমেরিটাস অধ্যাপক।
তিনি শিকাগাে বিশ্ববিদ্যালয়ে পােস্ট-ডক্টরাল। ফেলাে এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমিক স্টাফ ফেলাে ছিলেন। পাঁচ বছর যুক্ত ছিলেন জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে। কলকাতার মওলানা আবুল কালাম আজাদ। ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ, প্যারিস। বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারােলাইন স্টেট। ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলাে ছিলেন, বিশ্বভারতীতে ছিলেন ভিজিটিং প্রফেসর।
. বাংলা ও ইংরেজিতে তার অনেকগুলি বই। ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন ও টোকিওতে প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে তাঁর রচিত মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, স্বরূপের সন্ধানে, পুরােনাে বাংলা গদ্য, বাঙালি। নারী সাহিত্যে ও সমাজে, তাঁর স্মৃতিকথা কাল নিরবধি ও আমার একাত্তর, Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Office Library and Records, Creativity, Reality and Identity, Cultural Pluralism, Identity, Religion and Recent Hisotry এবং তাঁর সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড) বিশেষ উল্লেখযােগ্য। তিনি গবেষণায় বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার, শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচারে আনন্দ পুরস্কার লাভ করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছে। সরােজিনী বসু পদক, রবীন্দ্রভারতী দিয়েছে। সাম্মানিক ডি. লিট।