আমার ধারণা এবারের সংকলনটি অন্যান্য বারের তুলনায় একটু তাড়াতাড়ি বের
হয়েছে, মাত্র তিন বছরের মাথায় ছয় ছয়টি উপন্যাস-যারা অভিযােগ করে আমি
কম লিখছি, তারা এবারে নিশ্চয়ই সেই অভিযােগ করতে পারবে না। আমি ছেলে
বেলায় যে ধরনের বই পড়তে পছন্দ করতাম কিশাের-কিশােরীদের জন্যে লেখার
সময় এতদিন ঘুরেফিরে সেভাবেই লিখে এসেছি। আজকাল মাঝে মাঝে দেখি
নিয়মের বাইরে গিয়ে অন্যভাবেও লেখা হয়ে যাচ্ছে। তার একটা উদাহরণ
ইস্টিশন বইটি। এর আগে সবসময়ই বইয়ের চরিত্রগুলাের সাথে আমাদের
ছেলেমেয়েরা কোনাে না কোনােভাবে নিজেদের খুঁজে পেত। ইস্টিশন বইটিতে
সেটি হওয়ার কোনাে উপায় নেই, তার কারণ যাদের নিয়ে লিখেছি এই বইয়ের
পাঠকদের তাদের জীবনের সাথে সম্পর্ক থাকার সুযােগ নেই। কাজেই আমার
পাঠক-পাঠিকারা এই বইটিকে সেভাবে গ্রহণ না করলেও আমি একটুও অবাক
হতাম না। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ করেছি আমাদের ছেলেমেয়েরা গভীর
ভালােবাসা নিয়ে বইটা পড়েছে। শুধু পড়েনি, কেউ কেউ আমাকে বলেছে, স্যার,
"আপনি কোনাে চিন্তা করবেন না, দেখবেন আমরা যখন বড় হব তখন আমরা
সবার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিব। একজন লেখকের জীবনে এর থেকে বেশি আর
কী পাওয়ার থাকতে পারে?
এই সংকলনের আরেকটা উপন্যাস নিয়েও কিছু তথ্য দেয়া যেতে
পারে-সেটি হচ্ছে গাব্বু। আমি প্রথমে এটা লিখেছিলাম টেলিভিশনে বাচ্চাদের
নাটক হিসেবে। গাব্বুর কাহিনীটি আমার খুব পছন্দের কাহিনী, নাটকটা লেখার
সময় আমি খুব মজা পেয়েছিলাম। আমি অনেকদিন আগেই লক্ষ করেছি কেউ
যখন টেলিভিশনে কোনাে একটা নাটক দেখে সেটা সে এক সপ্তাহও মনে রাখে
না, কিন্তু একটা বইয়ের কথা চল্লিশ বছরও মনে রেখে দেয়। তাই আমার মনে
হল আমার এই প্রিয় গল্পটা সবাই এক সপ্তাহ পরে ভুলে যাবে সেটা কেমন করে হয়? এটাকে একটা বইয়ের মতাে লিখে ফেললে কেমন হয়? তাই কয়েকদিন
খাটাখাটুনি করে এটাকে একটা বই হিসেবে লিখে ফেললাম। এখানেই শেষ না,
এই বইটার আরও ইতিহাস আছে, আমার মনে হয় গাব্বু প্রথম একটা বই যেটি
একই সাথে তিনভাবে বের হয়েছে, ছাপা বই, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পড়ার জন্যে
ব্রেইল বই এবং শােনার জন্যে অডিও সিডি। এতদিন আমার আনন্দ ছিল যে
আমার লেখাগুলাে এই দেশের ছেলেমেয়েরা পড়ে, এখন আমার মনে ডাবল
আনন্দ, ব্রেইল বই আর অডিও বইয়ের কারণে এখন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলে-
মেয়েরাও আমার বই পড়তে পারবে, শুনতেও পারবে।
এই সংকলনের অন্য বইগুলােও একটু অন্যরকম, আমার মনে হয় আমার
ছােট ছােট পাঠকদের গিনিপিগ বানিয়ে তাদের উপর লেখালেখির এরকম
এক্সপেরিমেন্ট ভবিষ্যতে আরও হবে। আশা করছি তারা বেশি আপত্তি করবে না।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
মুহম্মদ জাফর ইকবাল জন্ম : ২৩ ডিসেম্বর ১৯৫২, সিলেট। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, পিএইচডি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন থেকে। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং বেল কমিউনিকেশান্স রিসার্চে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করে সুদীর্ঘ আঠার বছর পর দেশে ফিরে দীর্ঘদিন অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্ত্রী প্রফেসর ড. ইয়াসমীন হক, পুত্র নাবিল এবং কন্যা ইয়েশিম।