চার দশকের নিরন্তর সাহিত্যচর্চার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে হাসান আজিজুল হক মাত্র দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন, ‘রবীন্দ্র-উপন্যাসের স্বদেশ ভাবনা : গোরা’ ও ‘গ্রামের কথকতা : রবীন্দ্রনাথ’। জীবনের প্রৌঢ়তা পৌঁছে দুই হাজার সালের পরে রবীন্দ্রনাথের দিকে ফের ফিরে তাকিয়েছেন নিবিড়ভাবে। লিখেছেন বেশ কিছু প্রবন্ধ। প্রবন্ধগুলো প্রথম দুটো প্রবন্ধের মতো দীর্ঘ নয় এবং অধিকাংশ প্রবন্ধই বিশেষ অনুরোধে লেখা। প্রথম দুটো প্রবন্ধে রবীন্দ্র-চিন্তার যে স্বরূপ ফুটে ওঠে, পরবর্তী প্রবন্ধগুলোতে তার বিস্তৃতি ঘটে মাত্র। রবীন্দ্র-চিন্তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রচর্চার সামগ্রিক ফাঁক-ফাঁকি অথবা গ্রহণ-বর্জন নিয়ে কথা বলেছেন হাসান। তাঁর ভাষ্যমতে, রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক ও প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি কখনোই। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো একটি মামুলি ঘটনায় রাতারাতি বেড়ে গেল রবীন্দ্র-ভক্তি। তাঁর ব্যক্তিত্বের জৌলুস, সুমহান প্রতিভা, কঠিন জীবনব্রত আড়ালে পড়ে গেল রবীন্দ্র-ভক্তম-লির একচোখা অন্ধবিচারের কারণে। রবীন্দ্রসাহিত্য অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল ‘স্তবে, স্তুতিতে, এবং সাহিত্যবিচারের নামে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাওয়া গেল ‘প্রশ্নহীন ভক্তিভেজা প্রশস্তির মালা।’ বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রচর্চার এই ভ্রান্ত বা অসম্পূর্ণতার জায়গাটি হাসান আজিজুল হকের আগে কেউ এমন নির্মোহভাবে দেখিয়ে দিয়েছে বলে মনে হয় না। গোরা সম্পর্কে হাসানের অভিমত হলো, যে সমাজ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সত্তর বছর আগে ‘গোরা’ লেখা হয়েছিল বর্তমান বাস্তবতা তার অনেক দূরে। এখন আর আমাদের জীবনের সঙ্গে গোরার কোনো কিছুই মিলবে না। প্রসঙ্গত উপন্যাসটি বর্জনের প্রশ্ন ওঠে। কেন ‘গোরা’ উপন্যাস আজও পঠিত হয়? তার উত্তর আমরা পাই হাসানের কাছেই। তিনি বলেছেন, মহৎ উপন্যাস মাত্রই একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ মানবজগৎ থাকে, যেখানে থাকে আশা-আকাক্সক্ষা, প্রেম-দ্বন্দ্ব। ‘গোরা’র কাহিনিতে মাকড়সার জালের মতো তৈরি হয়েছে একটা শক্ত বলয়Ñযাতে আটকে পড়েছেন গোরার মতো ‘শক্ত হাড়ের মজবুত মানুষও।’ হাসান মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের মতো মহৎশিল্পীর সম্ভব এমন একটি জগৎ সৃষ্টি করা, যেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দেশ, সমাজ, সমাজের মানুষদের আশা-আকাক্সক্ষা-বেদনার সাথে একাত্ম হয়েছেন গোরার ছদ্মবেশে, যেখানে নিজেই গোরার চোখ দিয়ে দেখিয়েছেন ধর্ম কীভাবে মানুষের বিকাশের পথ আগলে ধরে, অসাড় করে ফেলে চিৎবৃত্তিগুলো। গোরা যে ভারত অনুসন্ধান করেছে শেষ বিচারে তা রবীন্দ্রনাথেরই কাম্য ভারতবর্ষ।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের গ্রামবাংলা বর্তমানের গ্রামবাংলা হতে যোজন দূরে। সেই আগের শাহজাদপুর, শিলাইদহের তেমন কিছুই মিলে না আজকের শিলাইদহ, শাহজাদপুরের। আমরা তো জানি, রবীন্দ্রনাথের গল্পের ভুবনের বাসিন্দারা প্রায় সবই পূর্ববাংলার। কালের প্রহারে পূর্ববাংলার সেই প্রকৃতি এখন বিবর্ণ, বিলীয়মান। হাসানের মতে, রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি বিশেষ স্থান-কালের হয়েও নির্বিশেষ, নিরপেক্ষ। গল্পের বিষয়ের সাথে এই প্রকৃতির যোগ যতটা নিবিড়, তেমন নিবিড় নয় বাইরের বাস্তব প্রকৃতির সাথে। বাস্তবে রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্রকৃতি ও মানুষ এখন আর আমাদের কাছেপিঠের কেউ নন। থাকারও যে কথা নয়, সময় এগিয়েছে, বদলেছে মানুষের মন ও কর্ম, বদলে গেছে সমাজ। ফ্রেমে বাঁধানো দুর্লভ ছবির মতোই আমাদের সামনে থেকে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের প্রকৃতি, মানুষ ও মানুষের বিচিত্র কর্মপ্রবাহ। গ্রাম বাংলার প্রকৃতি ও মানুষকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন খুব নিকটে দাঁড়িয়ে, অসামান্য জীবন আগ্রহ নিয়ে। না জমিদার হিসেবে নয়, আকণ্ঠ মানবতৃষ্ণা নিয়ে তিনি বাংলার গ্রাম ঘুরে নিরুপমা, চন্দরা, রতন, মৃন্ময়ী, ফটিকদের চিনে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে দেখেছেন আলগোছে, কবির চোখে, তাঁর গল্পে মানুষের চাইতে প্রকৃতিই প্রধান হয়েছে, প্রকৃতি দিয়ে ফাঁক বন্ধ করে মানুষের প্রবেশপথ সংকীর্ণ করে রেখেছেন। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে হাসানের পাল্টা প্রশ্ন, তবে রবীন্দ্রনাথের গল্পের মূল্য কোথায়, কেন প্রবলভাবে টানে আমাদের, সেই প্রকৃতি তো এখন আর নেই। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, দৈনন্দিন জীবনের সাথে প্রকৃতির নির্যাস রবীন্দ্রগল্পে এমন করে মিশে আছে, প্রকৃতি ও সমাজের নির্দিষ্ট রূপ এখন চিরকালের, সব মানুষের সম্পদ হয়ে গেছে। মৃন্ময়ী, ফটিক, রতন, শুভা, চন্দরারা এখন বিশেষ প্রকৃতি ও সমাজের কেউ না, চিরন্তন মানব প্রকৃতির অংশ, সব দেশের, সকলের। হাসানের তাই মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের গল্পের মৃত্যু নেই।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতা নিয়ে হাসান আজিজুল হবে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। রবীন্দ্র-বিতর্কের বহু প্রশ্নেরই উত্তর মেলে হাসান আজিজুল হকের এসব লেখায়।
এ গ্রন্থটি প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করায় ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের দুই সুহৃদ স্বত্বাধিকারী জহিরুল আবেদীন জুয়েল ও আদিত্য অন্তরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
হাসান আজিজুল হক
জন্ম : ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯। গ্রাম, বর্ধমান, পশ্চিমবাংলা। শিক্ষা : স্নাতকোত্তর, দর্শন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্র বিভাগে অধ্যাপনা শেষে তিনি অবসর নিয়েছেন। ছাত্রজীবনে লেখালেখির শুরু। ১৯৬০ সাল থেকে লেখক হিসেবে নিজেকে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সক্রিয় সাহিত্যচর্চার আরম্ভ । আজ তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক। বাংলাদেশের উল্লেখযােগ্য সব সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদকের অধিকারী তিনি। তার গল্প ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, রুশ ও চেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
লেখকের অন্যান্য গ্রন্থ
গল্প : সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, নামহীন গােত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, আমরা অপেক্ষা করছি, রােদে যাবাে, মা-মেয়ের সংসার, নির্বাচিত গল্প, রাঢ়বঙ্গের গল্প।
উপন্যাস : আগুনপাখি, সাবিত্রী উপাখ্যান।
উপন্যাসিকা : বৃত্তায়ন, শিউলি, বিধবাদের কথা।
প্রবন্ধ : কথাসাহিত্যের কথকতা, অপ্রকাশের ভার, অতলের আঁধি, চালচিত্রের খুঁটিনাটি, ছড়ানাে ছিটানাে, চিত্তন-কণা।আত্মজীবনী : ফিরে যাই ফিরে আসি (১ম অংশ), উকি দিয়ে দিগন্ত (২য় অংশ)।