বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে দেশপ্রেমের অমিত সাহসিকতায় তিনি অগ্রসর হয়েছেন। সহস্র চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র তাঁকে থামাতে পারেনি। মৃত্যুভয়, কারাযন্ত্রণা ও মৃত্যু-উপত্যকে অতিক্রম করেছেন আদর্শের পতাকা হাতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিলেন না সত্য, কিন্তু তিনি ছিলেন কোটি কোটি মানুষের অন্তরে। শত্রু হননের প্রতিজ্ঞায়। জনযুদ্ধের নির্দেশ ও প্রত্যয়ে তিনি ছিলেন দৃশ্যমান। তাঁর নামেই পরিচালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। তাকে ঘিরেই সমগ্র বিশ্ব আলােড়িত হয়েছে মুক্তির মিছিলে। বাংলাদেশ নামটিও তারই দেয়া।
পাকিস্তানের মৃত্যু-কারাগার থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। দেশ তখন মহাধ্বংস স্তুপে। রাষ্ট্রযন্ত্র বিকল। অবকাঠামাে ধ্বংস। কোটি কোটি বুভুক্ষু মানুষ। খাদ্য নেই, জমিতে ফসল নেই। ঘর নেই। আশ্রয় নেই। ছিন্নমূল মানুষ। মুদ্রা লুণ্ঠিত। লক্ষ লক্ষ অস্ত্র ছড়ানাে-ছিটানাে। সার্বিক বন্দর অচল। পাশাপাশি স্বাধীনতা ও দেশ-ধ্বংসের সশস্ত্র তৎপরতায় জাতীয়-আন্তর্জাতিক শত্ৰু-চক্র। জাতিসংঘের স্বীকৃতিহীন একটি রাষ্ট্র।
এমনি ভয়াবহ অবস্থায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাষ্ট্রকে জাতীয় রাষ্ট্রে উন্নীত ও সচল করার ক্ষেত্রে যে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংবিধানিক, বিচারিক, সার্বভৌমিক কাঠামাে নির্মাণে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-নির্ভর তৎক্ষণিক কর্মকাণ্ড কোন্ জাদুমন্ত্রে বঙ্গবন্ধু পরিচালিত করেছিলেন, তা আজ গভীর গবেষণার বিষয়। তাঁর নির্দেশ ও নির্দেশনা তাৎক্ষণিক হলেও তা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। তার সমগ্র জীবনের লালিত স্বপ্ন-সাধনা, আদর্শ ও নীতি বাস্তবায়নের যে পদক্ষেপসমূহ নিয়েছিলেন তা শুধু সমকালকে আলােকিত করেনি, মহাকালের পথ নির্মাণে তা ছিল প্রদীপ্ত বাতিঘর।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা অনেক কথাই বলি। কিন্তু কর্ম-পরিকল্পনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করলে যে সত্যটি বেরিয়ে আসবে তা হলাে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর স্কন্ধে অর্পিত না হলে যে- রক্তাক্ত বিভীষিকাময় নৈরাজ্য সৃষ্টি হতাে- সে ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের সংকট বিধ্বংসী রূপ নিত। সে সব বিষয় নিয়ে আজো গবেষণা হয়নি।
এটি কোনাে গবেষণা গ্রন্থ নয়। ভবিষ্যতে যারা গবেষণা করবেন, দেশ, জাতি ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সত্যনিষ্ঠতায় নির্মোহ বিচারে অগ্রসর হবেন তাদের জন্য এটি হবে সংক্ষিপ্ত আকরসূত্র। ১৯৭২ সনের ১০ জানুয়ারি, ১৯৭৩, ১৯৭৪ এবং ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত জাতির পিতার রাষ্ট্রচিন্তা, রাজনৈতিক দর্শন, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি-কৃষক, শিল্প-বাণিজ্য, শ্রমিক ও শ্রম মালিকানা, কর্মসংস্থান, দক্ষ মানব-সম্পদ গড়ে তােলা, আয় বণ্টন, সর্বোপরি শােষণহীন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য সদূর প্রসারী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন যার অপরিহার্যতা এবং প্রাসঙ্গিক কোনাে দিন ফুরিয়ে যাবেনা- নিঃশেষ হবে না।
কথিত পুস্তকে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র-চিন্তা, ভাবনা, দর্শন, স্বাধীন দেশের উপযােগী কাঠামােগত উন্নয়ণ পরিকল্পনা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিসমূহের পাশাপাশি স্বাধীনতা বৈরীর শক্তিসমূহের অপতৎপরতা এবং তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলাের ভূমিকা, যুদ্ধে বিপর্যস্ত জনগণের দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন দিনলিপি হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশে যেক্ষেত্রে প্রয়ােজন ছিল সহযােগিতা তার পরিবর্তে প্রতিবিপ্লবী শক্তি কীভাবে নাশকতা, জাতীদ্রোহি কর্মকাণ্ড, খুন-হত্যা, ছিনতাই, রাহাজানি, পুলিশ ফাঁড়ি লুট, এমনকী ঈদের নামাজে সংসদ সদস্যকে হত্যা করার নৃশংস তৎপরতায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ছিন্নভিন্ন করতে চেয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত তথ্য উপাত্ত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে মূল তথ্য, প্রতিবেদন, উপাত্ত, সংবাদ-সূত্র অবিকৃত রাখার সযত্ন প্রচেষ্টা ছিল। তারপরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারিখের বিভ্রাট থাকতে পারে, থাকতে পারে বাক্য-রীতির পরিমার্জন ও বর্ণবিন্যাসে ভুলত্রুটি।
বইটির তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে অনিম সাইয়িদ, ওসমান সজীব, ঝর্না আক্তার, নাসরিন আক্তার, তাহমিনা তালুকদার, আন্না আক্তার, ফারজানা, তানজিমা, জীবন দত্ত, মাে: মােস্তাফিজুর রহমান খােকন প্রমুখ। ব্যতিক্রমি ছবি সংগ্রহে শ্রম দিয়েছেন কমান্ডার শাহজাহান মৃধা বেনু, এম. এ মতিন, মির্জা সাখাওয়াৎ হােসেন, ডাক্তার মিটুন আক্তার লাকী, ইসমাইল হােসেন প্রমুখ। বাংলাদেশ আর্কাইভস-এর সিনিয়র রিসার্স অফিসার ইলিয়াস আলী মিয়া সর্বোতভাবে সহযােগিতা করেছেন।
অনন্যা প্রকাশনীর প্রকাশক মনিরুল হক আন্তরিকতা নিয়ে দ্রুত বইটি প্রকাশ করেছেন এবং সমগ্র বইটির বর্ণবিন্যাস করেছেন সালমান চৌধুরী। বইটির প্রচ্ছদ একেছেন ধ্রুব এষ। তাদের সকলকে ধন্যবাদ।
পরিশেষে, প্রয়াত সহধর্মিনী দিলরুবা আঙ্গুরীর প্রেরণা সর্বদা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং করে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ও অধ্যাপক মাহবুবর রহমান।
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন শিক্ষক ও রাকসুরভিপি। সত্ত্বরের নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের সাত নং সেক্টরের উপদেষ্টা ও ক্যাম্প ইনচার্জ। গণপরিষদে বাহাত্তরের খসড়া সংবিধান সংরচন কমিটির অন্যতম সদস্য। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পাবনা জেলা গভর্ণর ডেজিগনেট। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী। এছাড়া জাতীয় প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অভিজ্ঞতাঋদ্ধ। তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখ্য-ফ্যাক্টস্ এন্ড ডকুমেন্টস বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, মেঘের আড়ালে সূর্য, ছােটদের বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব, অঘােষিত যুদ্ধের বু-প্রিন্ট, ব্রুট্যাল ক্রাইমস্, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ: সিক্রেট ডিপ্লোম্যাসি, মুক্তিযুদ্ধ উপেক্ষিত গেরিলা, জেনারেল জিয়ার রাজত্ব, সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার প্রেক্ষিত ও গােলাম আযম, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঐতিহাসিক রায়, বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, বাংলাদেশ থ্রেট অব ওয়ার, একাত্তরে বন্দী মুজিব: পাকিস্তানের মৃত্যুযন্ত্রণা, সমাজ বদলে বঙ্গবন্ধুর বু-প্রিন্ট, মুক্তিযুদ্ধের দলিল লণ্ডভণ্ড এবং অতঃপর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা: কুটনৈতিক যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখােমুখি ও কোর্ট মার্শাল আমি মৃত্যুকে পরােয়া করি না ইত্যাদি।