...ধর্ম যদি মানব প্রজাতির সাথে সহবস্থানকারী হয়, যদি মানব সংস্কৃতির শুরুতেই ধর্মের ছাপ পাওয়া যায়, যদি ধর্মনিরপেক্ষ বর্তমান বিশ্বের প্রতিরোধক ব্যবস্থার পরও প্রবল উচ্ছ্বাসে ফিরে আসার ক্ষমতা থাকে, তাহলে আমরা মেনে নিতে বাধ্য যে, মানব প্রজাতি প্রথমত ধার্মিক এবং তারপর জ্ঞানী। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগেও প্রযুক্তিগত প্রগতির প্রান্ত সীমায় উপনীত দেশসমূহে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-সুফি ইসলাম-লোহিত ভারতীয় ইত্যাদি ধর্ম থেকে বহির্গত হাজার হাজার ধর্মচক্র এটাই প্রমাণ করে যে, মানুষ ঐতিহ্যগত ধর্মের মধ্যে সন্তুষ্টি খোঁজে না পেলেও তার অন্তর্নিহিত ধর্মীয় অনুভূতির সন্তুষ্টির জন্য হাজারো পন্থা তৈরি করেছে...।
...ধর্মের বিরুদ্ধতা শুরু এনলাইটেনমেন্ট বা জ্ঞানালোকের যুগ থেকে। ধর্মের প্রতি আলোকিত যুগের প্রতিক্রিয়া কিন্তু একরৈখিক ধর্মবিরুদ্ধতা ছিল না। ধর্মের বিরুদ্ধতা ছিল জ্ঞানালোকের বিশেষ এক ধারার বৈশিষ্ট্য, ভলতেয়ার যার গুরু। তার দ্বারাই প্রভাবিত মার্ক্স, নিটশে, ফয়েরবাখ প্রমুখ। অন্য প্রতিক্রিয়াগুলো হচ্ছে ধর্মসংশ্লিষ্ট। জার্মান এনলাইটেনমেন্ট রেফরমেশনে গভীরভাবে প্রোথিত। মেথডিজম ও পিটিজমের জন্ম জ্ঞানালোকের প্রতিক্রিয়াতেই। ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, এনলাইটেনমেন্ট খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করেনি বরং শুধু স্বল্প সংখ্যক চিন্তাবিদ ছিলেন নাস্তিক এবং আরো স্বল্প সংখ্যক ঘোষিত অজ্ঞেয়বাদী। অধিকাংশই এক ধরনের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথে জড়িত ছিলেন যার নাম যৌক্তিক একেশ্বরবাদ (উবরংস), যা ধারণা করে খোদার অস্তিত্ব আছে কিন্তু খোদা একবার নিখুঁত মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে এতে আর কোনো সক্রিয় আগ্রহ দেখান না। তারা স্রষ্টা খোদা মানেন, কিন্তু কর্তা খোদা মানেন না।...
...আসলে বিশুদ্ধ নাস্তিকের সাক্ষাৎ পাওয়া বড়োই দুষ্কর। বিরলতায় তারা বড়োই দুর্লভ। নাস্তিকদের বিরলতা সম্পর্কে ব্যাকনÑচিন্তাশীল নাস্তিক বিরল, একজন ডায়াগোরাস, একজন বিওন, একজন লুসিয়ান এবং আরো কিছু। তাদের সংখ্যা প্রকৃত পক্ষে যত তার ঢের বেশি মনে হতে পারে। কারণ প্রতিষ্ঠিত ধর্মমত এবং প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গেলেই মানুষ একে অন্যকে নাস্তিক নাম দিয়ে দেয়। ....
....নাস্তিক বলতে কোনো কালে কেউ ছিল না। নাস্তিক নামাবলিতে কেউ ছিল ছদ্ম-নাস্তিক, কেউ ছদ্ম-আস্তিক আবার কেউ বা অজ্ঞেয়বাদী। কারো কারো নাস্তিকতা ছিল আরোপিত। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের বিরোধের জের ধরে প্রতিক্রিয়াশীলতার আবেশজাত এক ধরনের মানসিক বিকার থেকে নাস্তিকতার শুরু। বর্তমানে সে বিরোধ ও বিকার অবসিত হয়েছে। আর নাস্তিকতাকে একটি শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে, নাস্তিকতার প্রচার ও প্রসার ঘটাতে পৃষ্ঠপোষকতা করত যে-বৃহৎ শক্তি, সে সোভিয়েত রাশিয়া এখন বিলুপ্ত। সোভিয়েতের পতনের মধ্য দিয়েই সমাজতন্ত্রের সাথে নাস্তিকতারও মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠে। নাস্তিকতা এখন মৃত। নাস্তিকতার সহায়ক মনোবিকার ঘটার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আর নেই। একটি শক্তি হিসাবে নাস্তিকতার প্রতিষ্ঠা লাভের সম্ভাবনাও তিরোহিত। সুতরাং নাস্তিকতার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাও আর নেই। নাস্তিকতার ভূত মানুষকে আর তাড়া করবে না। ক্ষণস্থায়ী মিথ্যা চোখ-ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য দেখিয়ে উত্থানরহিতভাবে নাস্তিকতার মৃত্যু ঘটেছে...।