প্রসব বেদনা নতুনত্বের সার্থক রূপায়ন
এবারের বই মেলায় কাকলী প্রকাশনী বের করেছে উদীয়মান এবং সম্ভাবনাময় লেখক সাদত আল মাহমুদের প্রসব বেদনা।একুশের বই মেলায় বইটি এসেছে। উত্তরবঙ্গের নিলফামারীর এক অজ পাড়াগায়ের ট্রাক ড্রাইভার মকবুলের পরিবারের সুখদুঃখের কাহিনী নিয়েই লেখক তার অসাধারণ উপন্যাসের পশরা সাজিয়েছেন। বইটির কাহিনী গড়ে উঠেছে এক সর্বহারার লেখক হবার স্বপ্নের সব কথা। বহমান জীবনের আলোকে যার ভেসে যাবার কথা। যার বাবা মারা যান অতি শৈশবে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে। সেখানে অবহেলা আর অনাদর। এরপর একসময় মাও তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যান সেই না ফেরার দেশে। এমনি শতেক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার এক উপাখ্যান সাদত আল মাহমুদের ‘প্রসব বেদনা’। সব সৃষ্টিতে প্রসব বেদনা থাকে। বিনা বেদনায় ভালো কিছু হয়না। একসময় মুখরোচক শ্লোগান ছিল, বিপ্লব মানেই ধ্বংস নয় সৃষ্টির প্রসব বেদনা মাত্র। তেমনি বেদনার প্রসব করেছেন লেখকের উপন্যাসের নায়ক জামাল। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার মানসিক শক্তি যিনি পেয়েছেন তার গর্ভধারীনির কাছ থেকে। সেই গর্ভধারীনির চলে যাবার পর থেকে এই বিশাল পৃথিবীতে তিনি একা হয়ে পড়েন। কখনো হোটেল বয় আবার কখনো বাসের কন্ডাকটর আবার জীবনের বাঁকে এসে হয়ে যান ছাপাখানার কম্পিজিটর। আবার শেষ জীবনে এসে হয়ে পড়েন স্টেশনের কুলি। জীবনের বাক বদলায় কিন্তু প্রত্যাশা পূরন হয়না। লেখক হবার স্বপ্ন তার অধরায় থেকে যায়। কিন্তু কথায় আছে. চেষ্টায় সব আশার বাস্তবায়ন এর বিকল্প নেই। তাইতো রেলের কুলি একদিন প্রকৃত লেখক হয়ে ওঠেন।
উপন্যাসের চরিত্র হিসাবে সাদত তার নায়ককে যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তা উপন্যাসের ধারা থেকেই স্পষ্ট। আমরা যে সব সিনেমা বা গল্প পড়ি সেখানে গল্পের নায়ক চিরকালই অপ্রতিরোধ্য। সাদতের উপন্যাসেও সেটির দেখা মেলে। আবার প্রেমপ্রীতি বিষয়ে আমাদের বদ্ধমূল ধারণা যে নায়ক নায়িকার শত বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে আসবে সেটিও প্রত্যাশিত তবে সাদতের উপন্যাসে এখানেই ব্যাতিক্রম। তার উপস্থাপনা এবং গল্পের স্টাইল প্রচলিত ধারনা থেকে অনেকটাই পাঠককে বের করে এনেছে। তার এই লড়াই সংগ্রাম এমনকি বেঁচে থাকার জন্য রুটি রুজির আবেদন রয়েছে তবে অবাধ প্রেমের অভাব নায়িকার। এক ঝলক চোখাচোখি আছে, আবার নীল বর্ণের মেয়ের সাথে একটি সঙ্গমময় রাত রয়েছে। তবে সেটি কোনভাবেই প্রেমের আদিখেত্যাকে স্পষ্ট করে না। বরং পদ্মাবতীর দৃঢ়তা মানবিকতা পাঠকের অন্তর ছুয়ে যায়। পরিসংখ্যানে এসে লেখক তার নায়ককে একজন লেখক হয়ে ওঠার সুযোগ এবং তার বাস্তবায়ন দেখিয়েছেন। একটু খটকা লাগলেও উপস্থাপনার ক্যারিশমায় তাকে সহজ পাচকে পরিণত করেছে। এক্ষেত্রে উপন্যাসের ক্যানভাসটা আরো একটু প্রশস্ত হলে পাঠকের আপত্তি ছিলনা।
উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে লেখক যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন একজন পাঠক তাতে রোমাঞ্চিত হবেন। কারণ আমরা অনেকেই উত্তরবঙ্গের ভাষার সারমর্ম উপলদ্ধিতে আনতে পারিনা। কিন্তু যেভাবে তার বয়ান দিয়েছেন তাতে পাঠকের বুঝতে কষ্ট হয়না এই ভাষার মর্মার্থ কী এবং কী হতে পারে। এখানেও লেখক নিজেকে একজন যথার্থ ভাষাবিদ হিসাবে প্রমান করতে পেরেছেন।
কাকলী প্রকাশনার এই প্রকাশনাটিযে পাঠক আনুকুল্য পাবে তা লেখকের সুন্দর গল্প বলায় স্পষ্ট। ৮৮ পাতার বইটির দাম রাখা হয়েছে ১৬০। সুন্দর মলাট আর ভারী কাগজে ঝকঝকে এবং তর তরে লেখা উপন্যাস ‘প্রসব বেদনা ’ নতুন সৃষ্টির উৎসবে সামিল হবে। কথক হিসাবে সাদত যে উচ্চ মানের তা তিনি আবারো প্রমান করেছেন।
কামাল সিদ্দিকী বাব
সাদত আল মাহমুদ
সাদত আল মাহমুদ। জন্ম পহেলা নভেম্বর ১৯৭৬ সালে টাংগাইল জেলায়। চিতার আগুনে উপন্যাসটি তার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ। দীর্ঘ দিন নাটক লেখালেখির সাথে জড়িত থাকার কারণে উপন্যাস তেমন একটা লেখা হয়ে ওঠেনি। নিয়মিত উপন্যাস লেখা তার অদম্য ইচ্ছা। উপন্যাসের পাশাপাশি ছোটগল্প, রম্যরচনা, প্রবন্ধ ও ভৌতিক গল্প লিখেন। প্রিয় পাঠক উপন্যাসটি যতœ সহকারে পড়লে আশাকরি ভালো লাগবে। পাঠকের ভালোলাগা ও ভালোবাসাতেই লেখার সার্থকতা।