ভূমিকা গীতিকবিরা সাধারনত ব্যক্তিগত ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হন বলে অনেক সময় নাটক রচনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারেন না। কারণ নাটক হচ্ছে একপ্রকার মিশ্র ধরণের বস্তুশিল্প, যেখানে নাট্যকার নিজের কথাকে চাপা দিয়ে রঙ্গমঞ্চে কুশীলবের কথা বলতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। অপরদিকে গীতিকবিরা নিজের কথাতেই মশগুল হয় থাকেন। তাই শেষ্ঠ গীতিকবিরা অনেক সময়ই শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হতে পারেন না। শেলী-কীটস-ব্রাউনিং রবীন্দ্রনাখ। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একথা অনেকাংশে সত্য।
রবীন্দ্রনাথ মূলত গীতিকবির প্রতিভা তা তিনি নাটক -গল্প-উপন্যাস যাই লিখুন না কেন।নিজস্ব আবেগ,কল্পনা ,স্বপ্ন ওতত্ত্ব্বাদ তার নাটকগুলোতে যে একটু প্রকটভাবে ধরা পড়বে তাতে আর বিস্ময়ের কিছু সেই । তবু তিনি নানা ধরণের নাটক রচনা করে ইতিহাসে বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছেন। লিখেছেন কাব্যনাট্য,নাট্যকাব্য, নিয়মানুগ নাটক, রঙ্গনাট্য, রূপক ও সাংকেতিক তত্ত্বনাটক। এসব ক্ষেত্রে তিনি স্বচ্ছন্দ পদচারণ করেছেন। তাঁর বাল্য ও কৈশোর কেটেছিল সেকালের ঠাকুরবাড়ির তরুণদের নবনাট্য আন্দোলন ও অভিনয়ের মধ্যে। পরবর্তীকালে এই মিশ্র সাহিত্যর প্রতি তাঁর উত্তরোত্তর আকর্ষণ বৃদ্ধি পায় এবং এই আকর্ষণ থেকেই তাঁর হাতে সৃষ্টি হয় বাংলা নাটকের বিচিত্র ধারা।
রবীন্দ্রনাথের তত্ত্ব-আশ্রয়ী সাংকেতিক নাটকগুলোর মধ্যে ‘রক্তকরবী’ অন্যতম। ‘রক্তকবরী’ প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে। এটি তাঁর এক অসাধারণ প্রতীক নাটক, বিশ্বের যে কোন একখানি শ্রেষ্ঠ প্রতীক নাটকের সমকক্ষ। এত রবীন্দ্রনাথ আধুনিক সমস্যার আর একটি উৎকট দিককে একটি অপরূপ প্রতীকতার মধ্যদিয়ে ব্যক্ত করেছেন। ‘রক্তকবরী’তে বর্তমান কারখানা ঘরের মধ্যে রুদ্ধশ্বাস মানবজীবন এবং লোভের ফলে মানুষের মানুষের মরণ ফাঁদের নিদারুন স্বরুপ অদ্ভুত প্রতীক ও রহস্যময় বঞ্চনার দ্বারা আভাসে ব্যক্ত হয়েছে।
‘রক্তকবরী’ নাকটটি প্রথমে ‘যক্ষপুরী’ নামে রচিত হয়েছিল,তার পর পাণ্ডলিপি অবস্থাতেই এ দ্বিতীয়বার নাম পরিবর্তন করে নতুন নামে রাখা হয়েছে ‘নন্দিনী’, শেষ পর্যন্ত গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার সময় এর ব্যঞ্জনানুসারে একে ‘রক্তকবরী’ নামে অভিহিত করা হয়। মাটির তলে যক্ষপুরী -অর্থ্যাৎ সোনার খনি। সেই অন্ধকারে শ্রমিকের দল অমানুষিক পরিশ্রমে তিল তিল করে সোনা তোলে। তাদের জীবনে অবকাশ নেই, আনন্দ নেই ,মুক্ত আকাশ নেই,সবুজ পৃথিবী নেই। তারা শুধু নেশাগ্রস্তের মত সোনা তোলে আর নেশা করে পড়ে থাকে। জলের আড়ালে আছেন স্বয়ং যক্ষরাজ, প্রচন্ড শক্তিধর,অমিত ঐশ্বর্যের মালিক। তাঁর নির্দেশে বড় সর্দার ,মেজ সর্দারের দলের যন্ত্রের মতো নিখূঁতভাবে কাজ চালিয়ে যায়, কোথা থেকে ক্ষীণতম প্রতিবাদ উঠলে অচিরেই তাকে চিরদিনের জন্যে তারা নীরব করে দেয়। শুধু রঞ্জনকে তারা করায়ত্ত করতে পারে না। তাকে যেন কোনো বন্ধনেই বাঁধা যায় না, ভয় দেখালে সে হেসে ওঠে। তার বেপরোয়া ব্যবহারে অন্যান্য শ্রমিকের মধ্যেও প্রতিবাদের কাঁপন লাগে।
এই প্রতীক নাটকটিতে যেমন আধুনিক জীবনের একটি অভিশপ্ত দিকের কথা কলা হয়েছে, তেমনি সূক্ষ্ণ ব্যঞ্জনার দ্বারা রক্তকবরীর রক্তিমার সাহায্যে অপরাজেয় প্রেম ও প্রাণের জয় ঘোষণা করা হয়েছে। রহুল আমিন বাবুল বি. এ (অনার্স), এম. এ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
রুহুল আমিন বাবুল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (জন্ম : ৭ মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (মৃত্যু : ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ - ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)। তিনি ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছােটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমােট ৯৫টি ছােটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খন্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খন্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নােবেল পুরস্কার পান।