‘ভরদুপুরে ও অন্যান্য গল্প’ তাশরিক-ই-হাবিবের সৃজনশীল প্রয়াসের প্রথম ভাষ্যরূপ। এ সংকলনে স্থান পেয়েছে পাঁচটি গল্প। আয়তনে কোনোটিই স্বল্পপরিসরের নয় বলে, পাশাপাশি লেখক হিসেবে নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন বলেও তিনি এ সংকলনে অধিক গল্প সন্নিবেশে অনাগ্রহী। তার মতে, লেখকের নিজস্বতা ও সৃষ্টিসামর্থ্য অনুধাবনের জন্য সচেতন পাঠকের পক্ষে পাঁচটি গল্পের পাঠগ্রহণই যথেষ্ট। মানব-মনস্তত্ত্বের প্রতি লেখকের দুর্নিবার আকর্ষণ প্রতিটি গল্পেই উপলব্ধি করা সম্ভব। তবে গল্পের উপজীব্য আখ্যান, সময়পরিসর ও স্থানপরিক্রমার যোগসাযুজ্যে পাত্রপাত্রীদের মনোলোক পাঠকের কাছে যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, সেই প্রকরণ, পরিচর্যারীতি ও ভাষারীতি গতানুগতিক নয়। বিশেষ করে উত্তরাধুনিক সাহিত্যভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সম্যক পরিচয় না থাকলে কোনো কোনো গল্পের বক্তব্য দুর্বোধ্য বিবেচিত হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় এ সংকলনের নামগল্পটির কথা। সালমা ও তার মা আদৌ জামান-রিনি দম্পতির বাসায় এসেছিল কি না, অথবা তারা ধর্ষিত হয়েছিল কি না অথবা তারা আত্মহত্যা করেছিল কি না, লেখক সেটি কখনোই স্পষ্ট করেন না। এ দম্পতির শিশুপুত্র আদৌ ভূমিষ্ঠ হয়েছিল কি না অথবা মৃত্যুবরণ করেছিল কি না, সেটিও আরেক কূটাভাষ বৈকি। জটিল থেকে জটিলতর আখ্যানপটে ঘটনার বিকল্প বয়ান গল্পটির একাধিক সম্ভাব্য পরিণতির দিকে পাঠকের সিদ্ধান্তকে আকৃষ্ট করে। লেখক এসব ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেন না, এমনকি পাঠককেও কোনো নির্দিষ্ট ভাবনায় আটকে দিতে চান না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গল্প হলো ‘গোলকধাঁধা’। এটি প্রথমবার পড়ে কারো কারো মনে হতে পারে, কেন্দ্রীয় চরিত্র সলীলের মনোবিকলনের দৃষ্টান্তগুলো ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু বাস্তবে যে তেমনটা হতে পারে, মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপ করলেই তা জানা যাবে। উভকামিতা কেন এবং কীভাবে ব্যক্তির অবচেতনে প্রাধান্য বিস্তার করে, এর অসামান্য নিদর্শন এ গল্পটি। এরকম গল্প এর আগে বাংলাদেশে লেখা হয়নি, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। নারীর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার চালচিত্র রয়েছে ‘জুলেখার দিনকাল’ ও লেনদেন’ গল্পদুটিতে। প্রথমটিতে এক উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণীর পরিচয় পাওয়া যায়, যে বয়সের আবেগ, প্রযুক্তির অভিঘাত ও অবচেতনে পুঞ্জীভূত ভীতিগত আর্কেটাইপের মিথষ্ক্রিয়ায় অসংলগ্ন আচরণ করে, যা কখনো কখনো সিজোফ্রেনিকও বটে। দ্বিতীয়টিতে উদ্ভাসিত হয়েছে একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীর প্রকৃত সামাজিক পরিচয় নির্ণয়ের মতো সংবেদনশীল প্রসঙ্গ। নারী কি প্রেমিকা, স্ত্রী, জননী, নাকি শেষ পর্যন্ত কামুক পুরুষের যৌনদাসী, বহুযুগের পুরোনো জিজ্ঞাসাই আবার একালের পরিসরে বাক্সময় হয়েছে গল্পটিতে। এ সংকলনের দলছুট গল্প নিঃসন্দেহে ‘কবিযশোপ্রার্থী’। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী, যারা পেশাজীবনে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তারা নিজেদের যখন কবি হিসেবে পরিচিত করতে চায়, তখন তাদের কোন কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, তার অনুপুঙ্খ শিল্পভাষ্য এ গল্প। গল্পটি পড়লে একে কোনোভাবেই গল্প বলে পাঠকের মনে হবে না। এর ঘটনা, প্রতিবেশ ও স্থানিক পটভূমি এত বেশি বাস্তবলগ্ন যে, কল্পনার প্রলেপ এ গল্পে খুঁজে বের করাটা আরেক দুরূহ ব্যাপার। যেন কোনো ঘরোয়া আড্ডায় ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে আলাপে ফুটে উঠছে গল্পকথক বিবৃত আখ্যান। বাংলা একাডেমির বইমেলার (২০১৪) পটভূমিতে বিন্যস্ত হয়েছে এর দীর্ঘ ঘটনাস্রোতের অনেকাংশ। সৃষ্টিশীল ব্যক্তিসত্তার আত্মপ্রকাশের অহর্নিশ যন্ত্রণার অনবদ্য ভাষ্যরূপ এ গল্প। এ সংকলনভুক্ত গল্পগুলোর প্রতিটিই অন্যটির চেয়ে ভিন্ন হলেও মেজাজ ও ভাবনার যে সুতোয় এরা বাঁধা, সেটি হলো মানুষের মনস্তত্ত্ব। গল্পগুলো পাঠ করে পাঠকেরা কখনো কখনো নিজেকে এর সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। কারণ জীবন আর সাহিত্য, একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠলে তবেই না লেখকের সৃষ্টিশীলতার স্বীকৃতি মেলে পাঠকমহলে! এ গল্প সংকলনটি পাঠককে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করবে।