একজন ব্যক্তি ধর্ম সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান রেখেও যেমন ধার্মিক বা ভক্ত না হতে পারেন; তেমনি ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও কেউ এ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারেন। আমার মধ্যে সব বিষয়েরই অভাব প্রকট, তবে হিন্দুধর্ম বিষয়ক বাংলা গ্রন্থের অভাব যে আরাে প্রকট, এটা আমি অনুধাবন করেছি এতদ্বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে গিয়ে।
এমনিতে বাংলা ভাষায় রচিত গ্রন্থের অভাব নেই; হিন্দুধর্ম বিষয়ক গ্রন্থও অগণিত। কিন্তু সম্পূর্ণ ধর্মকে এক সঙ্গে সহজে বােঝার মতাে কোনাে গ্রন্থ চোখে পড়ল না। বিভিন্ন শাখা, উপশাখায় বিভক্ত হিন্দুধর্মের কোনাে একটি বই পড়ে কেবল সেই শাখা বা মতের শ্রেষ্ঠত্ব বা গুরুত্বের কথা উপলব্ধি করা যায়। সেই মতের ধর্মগুরু বা প্রচারকের নানা উপদেশ বা তার নানা লৌকিক, অলৌকিক কাহিনি এসব গ্রন্থে প্রত্যক্ষ হয়। কিন্তু হিন্দু ধর্মের মূল যে দর্শন বা বৈশিষ্ট্য এ দিকটা উপেক্ষিত বা অদৃশ্য প্রায় সব গ্রন্থেই। আসাম, ত্রিপুরা এবং কলকাতা ঘুরেও যখন এধরনের একটি সহজ গ্রন্থের খোঁজ পাওয়া গেল না, তখন নিজেই এ কাজ সম্পাদনে ব্রতী হই। | একেতাে আমি জন্মসূত্রে হিন্দু, তারপর আবার পড়াশুনা করেছি বাংলা সাহিত্যে। হিন্দু ধর্মের নানা দিকে তাই চোখ পড়েছে খুব সহজেই। কিন্তু এর দর্শন বা গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপের প্রয়ােজন যখন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ালাে, তখন বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ক্রয় ও পাঠ করা ছাড়া বিকল্প কোনাে পথ অবশিষ্ট থাকলাে না। সহায়ক গ্রন্থ পাঠে প্রত্যাশা মতাে ধর্ম বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করতে না পেরেই বাংলাদেশে প্রাপ্ত বেদ, উপনিষদ ও পুরাণের দ্বারস্থ হতে হয়। কিন্তু এ সমস্ত আকর গ্রন্থের অনুশীলন, পঠনও বেশ কষ্টসাধ্য। সাধারণ পাঠক তাে বটেই, একইসাথে সাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাসের অনুরাগী পাঠক না হলে; কারাে পক্ষে এর সঠিক অর্থ উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। বিপত্তি অন্য জায়গায়ও আছে। | দেখা গেছে, কোনাে কোনাে গ্রন্থে শ্লোক সংখ্যা কম; আবার কোনাে কোনাে ঋক বেদে দশম মণ্ডলই অনুপস্থিত। এমতাবস্থায় বেশ ধৈর্য সহকারে, দীর্ঘ সময় ব্যয় পূর্বক বিভিন্ন শাখা-উপশাখার বহু গ্রন্থ পাঠ ও মূল ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে এর সঙ্গতি অসঙ্গতি বিচারের মাধ্যমে কিশাের-যুবাদের উপযােগী করে এ গ্রন্থটি রচনা করতে হলাে।
ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য
সাহিত্য ও সংগীতের বিভিন্ন দিকে আগ্রহ থাকলেও ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য মূলত একজন গবেষক। ইতােমধ্যে তাঁর বেশকিছু। গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে সিলেটের বাউলসংগীতে শাহজালাল ও চৈতন্যের প্রভাব, বাউল বৈষ্ণব সুফি, বাঙালির নৃতত্ত্ব ও হিন্দুসভ্যতা, আর্য প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। সিলেটের বাউলসংগীতে শাহজালাল ও চৈতন্যের প্রভাব শীর্ষক গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, নব্যবৈষ্ণববাদ ও সুফিবাদের মিশ্রণ যেসব অঞ্চলে ঘটেছে, সেসব অঞ্চলেই বাউল, বাওলা বা সে ধরনের মরমীসংগীত সৃষ্টি হয়েছে। বাউল বৈষ্ণব সুফি গ্রন্থে তিনি এই মতবাদগুলাের মধ্যে তুলনামূলক আলােচনা ছাড়াও উল্লেখ করেছেন যে, বড়ু চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি অবৈষ্ণব কবি ছিলেন বলেই তাদের হাতে প্রকৃত অধ্যাত্মরস সমৃদ্ধ কাব্য রচিত হয়নি বা তারা তা করেন নি। চৈতন্য পরবর্তী অন্যান্য। কবি রচিত রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদ অধ্যাত্ম উদ্দেশ্যে রচিত হওয়ার কারণেই পূর্ববর্তী পদ অপেক্ষা স্বতন্ত্র। বাঙালির নৃতত্ত্ব ও হিন্দুসভ্যতা' এবং আর্য’ তার বহুল আলােচিত দুটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থসমূহে তিনি বােঝাতে চেয়েছেন যে, আর্য হিসেবে উল্লিখিত জনগােষ্ঠী ভারতের বাইরে থেকে আগত নয়। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারাের সভ্যতাও যুদ্ধ নয়, প্রবল বন্যাজনিত কারণে ধ্বংস হয়েছে। তবে প্রথমােক্ত গ্রন্থের গুরুত্ব অন্য কারণে। তিনি মনে। করেন, আদি অস্ট্রোলয়েড নামে কথিত নরগােষ্ঠী আফ্রিকা থেকে তৎকালীন স্থল পথে কয়েক সহস্র বছরের চেষ্টায় ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় আসতেই পারে, তবে তাঁর মতে, যখন পৃথিবীর সবগুলাে মহাদেশ একজায়গায় বা খুব কাছাকাছি অবস্থানে ছিল, তখনই অস্ট্রোলয়েড নরগােষ্ঠীর প্রাণকণা একই সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকা, ভারতের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল এবং অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তীকালে ভূখণ্ডগুলাে পরস্পর বিচ্যুত হয়ে স্থানান্তরের সময় ওই প্রাণকণাগুলাে বিবর্তিত হতে থাকে। বিবর্তনের মাধ্যমেই স্ব স্ব ভূখণ্ডে একসময় প্রায় কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের নরবানর ও নরের উৎপত্তি ঘটায়। এসমস্ত অঞ্চলের মানুষের নৃতাত্ত্বিক মিলগুলাের কারণও তাঁর মতে এটাই। উত্তর-আফ্রিকা, ভূমধ্যসাগর এবং উত্তরপশ্চিম ভারতীয় অঞ্চলের নৃগােষ্ঠীর মধ্যেও সমান্তরাল কারণেই মিল খুঁজে পাওয়া যায় বলে তিনি এই গ্রন্থে অনুমান করেছেন। ভারতীয় বা বাঙালির নৃতত্ত্ব বিশ্লেষণে এটি একটি নতুন ধরনের চিন্তা বলেই মনে হয়।