পদতলে চমকায় মাটি - সুহান রিজওয়ান | বইবাজার.কম

পদতলে চমকায় মাটি

    4 Ratings     1 Reviews

WISHLIST


Overall Ratings (1)

Hassan
31/03/2019

পদতলে চমকায় মাটি সমর কুমার চাকমা নামে রাঙামাটি থেকে ঢাকায় ক্লাব ফুটবল খেলতে আসা এক উদীয়মান তরুণ ফুটবলারের গল্প। তেমনি এটি আবার সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে পার্বত্য শান্তি চুক্তির বর্তমান অবস্থা নিয়ে রিসার্চের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে যাওয়া আরিফের গল্পও। গল্পের এই দুই ধারা সমান্তরাল ভাবে চলে গেলেও, মূল সুরটা আসলে পার্বত্য রক্তাক্ত সেই জনপদের দিকেই ছিল। সুহান রিজওয়ান আলোকপাত করেছেন বছরের পরে বছর ধরে চলে আসা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে চলে আসা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, শোষণ, বঞ্চনা আর অবিচারের দিকে। পাহাড়ের চলে আসা এতসব স্পর্শকাতর ব্যাপার নিয়ে অস্বস্তিজনক ভাবে প্রায় নিরব থাকা আমাদের ইলেকট্রনিক-প্রিন্ট মিডিয়া বা সাহিত্যিকদের সামনে এই বই দারুণ একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। সমর বল নিয়ে মাঠে যতটা দক্ষতা-নৈপুণ্য দেখাতে পেরেছে, নিজের জীবন নিয়ে অবশ্য ততটা পারে নি। সেই স্পৃহাটাও তার ভেতরে ছিল না, সম্ভবত সেটা ভেঙ্গে গিয়েছিল ছোট বেলায় বাপের পিঠে সেনাবাহিনীর বুটজোড়ার আঘাতেই, যার ফলে ফুটবল খেলতে নেমেও বুটজুতোর প্রতি তার আজন্ম এক ভয় ধরে গিয়েছিল। তবে কি না, মূল চরিত্র হয়েও যেন সমর ঠিক মূল চরিত্র নয়, বরং সেটা হয়ে উঠেছে পাহাড়ে বছরের পর বছর চলে আসা এবং চলমান নানাবিধ উভমুখী সমস্যাই। সেই কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের শুরতে পাহাড়ের জনগণের ভূমি হারানো থেকে শুরু করে পাহাড়ে বাঙ্গলি সেটলার পুশ করে দেয়া, শান্তিবাহিনী গঠন, জুম্ম ল্যান্ড গঠনের আন্দোলন, পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ, পার্বত্য দল গুলোর মধ্যে বিভাজন, পাহাড়ের ভাতৃঘাতি সংঘর্ষ, প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অসহযোগিতা, মিডিয়ার হিপোক্রেসি, শান্তি চুক্তির অসারতা সহ প্রায় সব দিকেই আলোকপাত করেছেন হিমেল আর আরিফের রিসার্চের মোড়কে। এইখানে দুটো কথা বলে রাখা ভালো, এত এত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকার পরেও একবারও মনে হয় নি যে কোন গবেষণা গ্রন্থ বা ডকুমেন্ট পড়ছি৷ আরেকটা যেটা, সেটা হলো সমস্যা গুলো একপেশে ভাবে না দেখিয়ে যেমন দেখানো হয়েছে পাহাড়িদের দৃষ্টিতে, তেমনি বাঙ্গলি সেটলারদের দৃষ্টিতেও। বাদ যায় নি শান্তিবাহিনীর প্রাক্তন গেরিলা বা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আর সরকারি অফিসারদের দৃষ্টিভঙ্গিও। এই যে সবরকম পরিস্থিতিকে খুটিয়ে দেখা, এটা বইটাকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। পড়তে গিয়ে পাঠক স্বভাবতই বিস্মিত হবেন এই লেখার পেছনে লেখকের কি বিপুল কর্মযজ্ঞ রয়েছে তা কল্পনা করে। বইটিতে সুহান অবশ্য এসব সমস্যার কোন সমাধান দেন নি। সেটা একদিকে যেমন লেখকের উদ্দেশ্যও ছিল না, তেমনি পার্বত্য সমস্যাটা এত জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এর কোন সহজ সমাধান কল্পনা করাও আসলে কষ্টকল্পনা। লেখকের মূল উদ্দেশ্য ছিল যেটা, অবহেলিত, বঞ্চিত আর রক্তাক্ত এক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সমতলের মানুষকে কিছুটা হলেও অবহিত করা, সেক্ষেত্রে তিনি সফল। সর্বদা আপোষকামী হিপোক্রেট মধ্যবিত্তের যে চরিত্র তিনি এঁকেছেন আরিফের মাধ্যমে, তার সাথে নিজের মিল দেখে প্রায় সব পাঠকই সূক্ষ্ম অস্বস্তি বোধ করবেন। আবার এটাও এই চরিত্রটাকে ভালোবাসার কারন হয়ে দাঁড়াবে, আরিফের মতই আমরা প্রায় সবাই দেশের চলমান সমস্যাগুলো নিয়ে সচেতন, রাগে দুঃখে আমরাও প্রতিবাদ করতে চাই, জ্বলে উঠতে চাই, আবার সব দেখে শুনে অসহায় হয়ে আপোষও করে ফেলি৷ একেবারে শেষটায় তাই আরিফে আর হিমেলের বিপরীতমুখী পরিবর্তনটা আমাদের অবাক করে না। এটাই তো হয়ে আসছে। আরিফের স্মৃতিচারণ আর তার বন্ধুদের ক্যাম্পাস-আড্ডায় যেভাবে শাহবাগের গনজাগরণে মঞ্চ থেকে শুরু করে হালের ডাকসু নির্বাচনের সম্ভাবনা, কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন, কিংবা প্রশ্নফাঁস থেকে ব্লগার হত্যাকাণ্ড উঠে এসেছে সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়, আর বর্তমান সময়কে এভাবে কোন বই এখনো তুলে ধরেছে বলে জানাও নেই আমার৷ ম্যাডাম আর আপার জাতীয় শস্য পার্টি আর নদীমাতৃক বাংলাদেশ দলের কীর্তিকলাপ নিয়ে নির্ভয়ে লিখাটাও একটা বিশাল দিক। ইস্পাত-দৃঢ় মনোবলের শামীম আজাদ পছন্দনীয় একটা চরিত্র, যা সবারই ভালো লাগবে। মাঝে এক ঝলক ঘুরে যাওয়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শহীদ নূর হোসেন কিংবা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ারা এসে তৃপ্তির একটা পরশ বুলিয়ে যান। আর এদেরই মধ্যে ফিরে ফিরে আসে শান্তিপ্রিয়া। সুহান রিজওয়ান যেভাবে সময়কে নিয়ে খেলা করেছেন পুরো বইয়ে, ঈর্ষান্বিত ও মুগ্ধ দুটোই হয়েছি। সমর হাটছে, খেলছে, এর মধ্যেই স্মৃতির করোটিতে জমিয়ে রাখা একেকটা ঘটনাকে নামিয়ে আনছে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে, এই ব্যাপারটা প্রচন্ড মুগ্ধ করেছে। আর লেখার স্টাইলের কথা বলাই বাহুল্য, সেটা যারা সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রান পড়েছেন, তারা অবগত আছেন। প্রচ্ছদ নিয়ে দুটো কথা বলতেই হয়, বইয়ের প্রচ্ছদটাই পুরো বইয়ের মূলভাবটা বহন করে। মাঝামাঝি কালো বর্ডার লাইনের মুখোমুখি একজোড়া খালি পা আর একজোড়া বুটপড়া পায়ের ছাপ। যেনো পাহাড়ের মালিকানা নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ানো আদিবাসী আর বাঙ্গালি। চমৎকার এই প্রচ্ছদটি করেছেন ইশতিয়াক আহমেদ অর্নব৷ সবশেষে, এই কথাটাও না বললে অন্যায় হবে যে, আদিবাসী বা পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা বা রাজনীতি, নিদেনপক্ষে ফুটবল নিয়েও যদি কারো আগ্রহ না থাকে, তবে এই বই পড়ে আপনার বোর হওয়ার যথেষ্ট চান্স আছে, সেটা লেখকের অনন্য লেখার পরেও। বইটিতে তথাকথিত টুইস্ট বা প্রেম ভালোবাসা নেই, কিন্তু সমসাময়িক কালকে ধরে রাখার মত বইও এটার সমকক্ষ একটা নেই। আমার ভালো লেগেছে। #বইবাজার_রিভিউ_প্রতিযোগিতা_মার্চ_২০১৯


PAYMENT OPTIONS

Copyrights © 2018-2024 BoiBazar.com