‘পথের পাঁচালী' গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে। তারও বছরখানেক আগে ‘বিচিত্রা' পত্রিকায় এর ধারাবাহিক প্রকাশ আরম্ভ হয়। ‘পথের পাঁচালী’ যখন জনসমাজে আত্মপ্রকাশ করল, তখন কল্লোল-যুগের প্রাথমিক উত্তেজনা অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। সে যুগের সংশয় অস্থিরতা, বিচিত্র উগ্র মতবাদের সংঘাত, বাঙালির জীবনবােধকে অনেকখানি উদ্ভ্রান্ত ও অন্তর্দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
বাংলা সাহিত্যের ঠিক সেই যুগসন্ধিলগ্নে এল ‘পথের পাঁচালী'। তার এই আবির্ভাব অপ্রত্যাশিত প্রভাব বিস্তার করল বাঙালি পাঠকের মনে। পাঠকসমাজ অকুণ্ঠ সংবর্ধনায় ‘পথের পাঁচালী'র স্রষ্টাকে স্বীকৃতি জানাল। মার্ক্সীয় সাম্যবাদ ও ফ্রয়েডীয় জটিল মনঃসমীক্ষণের উপাদানে যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর পটভূমিতে কল্লোল-যুগের যে জীবনবােধ গড়ে উঠেছিল—সেই পরিবেশে ‘পথের পাচালী’র এই বিস্ময়কর জনপ্রিয়তার কারণ কী? সে কি শুধু এই কারণে যে কল্লোল’-এর ঝাঁজালাে জীবনবােধের হাত থেকে সাধারণ মানুষের সহজ মন মুক্তি খুঁজছিল? ‘পথের পাঁচালী’র সহজ অনাড়ম্বর ঘরােয়া পল্লিকাহিনী মানুষের কাছে সেই মুক্তির অবকাশ এনে দিয়েছিল—“পথের পাঁচালী’র জনপ্রিয়তার এটি হয়তাে অন্যতম কারণ, কিন্তু একমাত্র কারণ নয় নিশ্চয়ই। ‘পথের পাঁচালী” যদি কেবল একটি যুগসন্ধির সাময়িক প্রয়ােজন মেটানাের জন্যই তখনকার মানুষের প্রিয় হয়ে উঠত, তাহলে নিশ্চয়ই সে জনপ্রিয়তা অল্প কিছুকালের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে আসত। কিন্তু সে কথা যে সত্য নয়, উত্তরকালের ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেবে। বাংলা সাহিত্যে পথের পাঁচালী’ অনশ্বর আসন লাভ করেছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১২ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ - ১লা সেপ্টেম্বর,১৯৫০) ছিলেন একজন জনপ্রিয় ভারতীয়বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তিনি মূলত উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। পথের পাঁচালী ও অপরাজিত তাঁর সবচেয়ে বেশি পরিচিত উপন্যাস। অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, ইছামতী ও অশনি সংকেত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসের পাশাপাশি বিভূতিভূষণ প্রায় ২০টি গল্পগ্রন্থ, কয়েকটি কিশোরপাঠ্য উপন্যাস ও কয়েকটি ভ্রমণকাহিনী এবং দিনলিপিও রচনা করেন। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়পরিচালিত চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। ১৯৫১ সালে ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার রবীন্দ্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।